নৈতিকতা কি?
এ বিষয়ে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী আলোচনা
করার পূর্বে মনে রাখা দরকার (Ethics) নীতি বিজ্ঞান, বা নৈতিকতা (Morality)
এসব বিষয়কে একত্রে ইসলামের দৃষ্টিতে আখলাক্ব বা চরিত্র বলে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে রচিত
গ্রন্থকে ইল'মুল আখলাকু' বা চরিত্র বিষয়ক জ্ঞান বলে। মানব চরিত্রকে বিশ্লেষণ করলে দেখা
যায় মানব চরিত্রের ভালো দিক এবং মন্দ দিক দুটি দিক বিদ্যমান। সুন্দর ভালো উত্তম আচরণকে
اخلاق حميدة প্রশংসনীয় এবং মন্দ খারাপ বা নিংকৃষ্ট দিকগুলোকে اخلاق ذميمه বর্জনীয় বা মন্দ চরিত্র বলে। এখানে আমরা প্রথমত উত্তম
চরিত্রের দিক এবং নৈতিক চরিত্র কিভাবে বা কিসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে সে বিষয় এবং
বর্জনীয় মন্দ চরিত্রের কতিপয় দিক তুলে ধরবো যাতে উত্তমচরিত্র কে ধারণ করা যায়, চিহ্নিত
মন্দ দিকগুলো পরিহার করা যায়।
اخلاق বা চরিত্র
আখলাক বা চরিত্রকে ইংরেজীতে Character
বলা হয়। ‘ওয়েবষ্টার’ ডিকশনারীতে চরিত্রের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে A distinctive mark. Adistinctive essencial qualities nature, pattern
of behaviour, personality, moral strength, self discipline, self motivation.
অক্সফোর্ড ডিকশনারীর সংজ্ঞানুসারে
Character is the particular combination of qualities in a person
that makes him different from others. It is such a quality which leads a man to
be determined and able to bear difficulties.
SAMSAD English-Bengali Dictionary তে Charecter-এর সংজ্ঞায় উল্লেখ করা হয়েছে A quality or peculiarity গুণ, ধর্ম, বৈশিষ্ট্য The
aggregate of moral qulities নৈতিক চরিত্র well marked personality ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন পুরুষ।৬
ইমাম গাযযালী রহ. এর সংজ্ঞা
Akhlaq is an established state of the soul from which actions
proceed easily without any need for reflection and delebaration. If this action
is good praised by the shariah. It is to be called good Aklaq حسن خلق on the other hand if such actions proceed from the state of soul
are evil not recommended by shariah is to be called bad Alaq (سؤ الخلق)
আসলে সচ্চরিত্র হলো মনের কতগুলো মূল্যবোধ,
কথা ও কর্মে মেজাজ ও প্রকৃতিতে, চিন্তায় ও চেতনায় একটি পবিত্রভাব যেগুলো মানুষকে তার
ন্যায় ও সত্যপথে অবিচল রাখে।
মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, আখলাক্ব
বা নৈতিকতার গুণে ও এর অনুশীলনে মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারবে। আখলাকের মন্দ দিক
মানুষকে পশুসম বা তার চেয়ে অধমে পরিণত করে। আল কুরআনের ভাষায়-
أولَئِكَ كَالْأَنْعَامَ بَلْ هُمْ أَضَلُّ .
তারা পশুর মত বরং তার চেয়েও নি:কৃষ্ট।৭
চরিত্র গঠনের/আখলাক গঠনের উপাদান
মানব চরিত্র বা আচরণকে উন্নত পর্যায়ে
নিয়ে যাওয়ার জন্য তার মধ্যে কতগুলো উপাদান থাকা বাঞ্চনীয়। এগুলো দুভাগে ভাগ করা যায়।
মৌলিক মানবীয় গুণাবলী বা মানুষের চরিত্রের উপাদান। অপরটি হচ্ছে ইসলামী নৈতিকতা মানবীয়
গুণাবলী অনেকের মধ্যে আছে কিন্তু ইসলামী নৈতিক গুণাবলী ভিন্ন বিষয় এগুলোর স্বরূপ ও
প্রয়োজনীয়তা যথাস্থানে আলোচনা করা হবে।
৬. Samsad English to Bengali Dictionary page-169 5th addition.
৭. সূরা আ'রাফ: ১৭৯
মৌলিক মানবীয় গুণাবলী যেমন-
১। (صدق সত্যবাদিতা (Truthfulness)
২। বিশ্বাস যোগ্যতা বা আস্থাভাজন হওয়া
(Trust worthiness)
3. (الحكمة) প্রজ্ঞা (Wisdom)
৪। সততা (Honesty)
৫। ভদ্রতা (Politeness)
৬। উদারতা (Generosity)
৭। অতিথি পরায়ণতা (Hospitality)
৮। দয়া (Kindness)
৯। ওয়াদা বা অঙ্গিকার রক্ষা করা (Fulfillment of promise)
১০। আমানত দারি (Trust worthiness (امانة)
১১। সুবিচার (Justice عدل / قسط)
১২। লজ্জা (الحياء) (Shyness)
১৩। কৃতজ্ঞতা (شکر) (Gratitude)
১৪। নিষ্ঠা, একাগ্রতা (Sincerity
اخلاص)
১৫। ধৈর্য ও ক্ষমা (Tolarance and Forgiveness صَبْرٌ عَفُوٌّ)
১৬। বিনয় ও নম্রতা (Modesty)
১৭। সাহস/হিম্মত (شجاعة) (courage/forbearance/bravery)
উল্লেখিত গুণাবলী ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে
অনেকের মধ্যে পাওয়া যায় এসব গুণের কারণে বা যার চরিত্রে এসব উপাদান বিদ্যমান সে সমাজে
নেতৃত্ব দানে ও সমাজ পরিচালনায় যোগ্য কোন সন্দেহ নেই এসব লোক সমাজের অন্যান্যদের তুলনায়
আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী এসব গুণ কারো মধ্যে না থাকলে তিনি শারীরিকভাবে বেশ ভূষায়
যত সুন্দর হোন না কেন চারিত্রিক দিক থেকে তিনি সুন্দর নন তাতে কোন সন্দেহ নেই। উপরন্ত
এসব গুণাবলী নৈতিকতার উপাদান বা উৎস।
এজন্য এসব গুণাবলীর উপর সংক্ষিপ্ত
আকারে হলেও আলোচনা করা প্রয়োজন। উপাদান গুলোর উপর আলোচনার পূর্বে নৈতিকতা কী? এবং নৈতিকতার
ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আলোচনা করা হবে।
নৈতিকতার সংজ্ঞা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী
প্রকৃতপক্ষে নৈতিকতার প্রকৃত ও মূল
ভিত্তি হচ্ছে ইসলামী আকাঈদ। আকাঈদ হচ্ছে বিশ্বাস ও প্রত্যয় সম্পর্কিত কতিপয় মৌলিক বুনিয়াদী
বিষয় যেগুলোর উপর সুদৃঢ় আস্থা বিশ্বাস মানুষকে উন্নত নৈতিক জীবে পরিণত করে। আল্লাহর
একত্ববাদ, নবীর রিসালাত, আখিরাত বা মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কিত প্রত্যয়, এসব বিশ্বাস
ছাড়া মানুষ সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে পারে না।
নীতি সম্বন্ধীয় বিষয়কে নৈতিক বলে
(নীতি+ইক)৮ নৈতিক শব্দের ইংরেজী প্রতি শব্দ Moral, ethical. Moral character, Morality; Principles concerning
right and wrong of good and bad behaviour, particular system of moral
principles Muslim/Hindu Christian morality।৯
নৈতিকতা সম্পর্কিত উল্লেখিত শব্দ সম্ভার
খুবই তাৎপর্য পূর্ণ ও অর্থ বোধক নীতিবান, নৈতিকতা, নৈতিক চরিত্র যে একটি মহৎ গুণ এতে
কোন সন্দেহ নেই।
ইংরেজী Ethics শব্দের
বাংলা প্রতিশব্দ ‘নীতিবিদ্যা’। এ Ethics শব্দের উৎস গ্রীক শব্দ Ethos। Ethos শব্দের
বাংলা অর্থ হলো আচার ব্যবহার বা চরিত্র বা রীতিনীতি (Usages) বা
অভ্যাস (Habits)। সুতরাং শাব্দিক অর্থে নীতিবিদ্যাকে মানুষের রীতিনীতি বা
আচার ব্যবহার সম্পর্কীয় আলোচনা বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। Ethics- কে
Moral philosophy বা নীতি দর্শন নামেও অভিহিত করা হয়।১০
ইমাম গাযালী (রহ.) নৈতিকতার প্রচলিত
পরিভাষাগত সংজ্ঞা প্রদান করে লিখেছেন, 'নৈতিকতা বলতে অন্তরে বদ্ধমূল এমন অবস্থাকে বুঝায়
যা মানব চরিত্রে পরিদৃষ্ট ও প্রতিফলিত হয়। যদি মানব প্রকৃতির অবস্থা মন্দ হয় তবে তাকে
অসৎ চরিত্র বলা হয়। আচরণ সুন্দর হলে তা সুচরিত্র।' তিনি বলেন, আখলাক বা চরিত্র কর্মকাণ্ডের
নমনীয় বা ভালো বা মন্দ প্রকৃতিকে বুঝায়। আরো স্পষ্ট করে তিনি বলেন, ভালো ও মন্দ কাজের
ক্ষমতাকে আখলাক বা চরিত্র বলা হয় না; বরং চরিত্র বলা হয় মানব প্রকৃতির এমন অবস্থা বা
স্বরূপকে যে প্রকৃতি ও স্বভাবের কারণে মানুষ ভালো অথবা মন্দ কাজে লিপ্ত হয়।১১
৮. সূরা আল আ'রাফ: ১৭৯।
৯. Bengoli English Dictionary, Bangla academy, Ninth Reprint, october,
p 385.
১০ ড. মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম, নৈতিকতা
ও মানবিক মূল্যবোধের ধারণা, আজিজিয়া বুক ডিপো, মে ২০০৪ ঢাকা পৃ. ০২।
১১. অধ্যাপক আইয়ুব, অধ্যাপক মাওলানা
মুহাম্মদ আবুল কাসেম মুহাম্মদ সিফাতুল্লাহ অনূদিত। ইসলামী দর্শন ও সংস্কৃতি ২০০৪ ইফা
ঢাকা পৃ. ১৭১।
আল-ফারাবির মতে, সদগুণ হলো ন্যায়-অন্যায়ের
পার্থক্য বুঝানো, নৈতিক নিয়মানুসারে কাজ করার প্রবণতা। অন্যকথায়, সদগুণ আত্মার এমন
একটা অবস্থা যার সাহায্যে মানুষ ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়।১২
আল কাসিমুল মুমীত (اَلْقَاسِمُ الْمُمِيتُ) অভিধানে চরিত্র শব্দের আভিধানিক
অর্থ লেখা হয়েছে স্বভাব-প্রকৃতি ও মেজাজ।
আল-কুরআন এতদপ্রসঙ্গে ‘খুলুক’ শব্দ
ব্যবহার করেছে। মহানবী মুহাম্মদ- এর উন্নত নৈতিক চরিত্রের প্রশংসা করে মহান আল্লাহ
তাআলা বলেছেন।
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ .
'আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।১০
অভ্যাস অর্থেও কুরআনে (خلق) ‘খুলুক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
যেমন-
إِنْ هَذَا إِلَّا خُلُقُ الْأَوْلِينَ .
'এসব কথাবার্তা পূর্ববর্তী লোকদের
অভ্যাস বৈ নয়।১৪
এছাড়া খুলুক শব্দ প্রাচীন প্রথা (Customs)
ধর্ম, নৈতিকতা, চরিত্র (Character), আদর্শ (Ideology), নীতি (Doctrine)
ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর খুলুক শব্দের বহুবচন আখলাক। জ্ঞানের পরিভাষায় এমন
শক্তিকে ‘খুলুক’ বা চরিত্র বলা হয় যার কারণে কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই মন থেকে ক্রিয়া
কর্ম বিকশিত হয়।
কারো কারো মতে, নীতিবিদ্যা হলো মানুষের
চরিত্র বা আচার সম্পর্কীয় বিজ্ঞান। নীতিবিদ্যা মানুষের ঐচ্ছিক কর্মের, অভ্যাসের এবং
চরিত্রের নৈতিক মূল্য বিচার করে অর্থাৎ এসবের ভালোত্ব-মন্দত্ব, ঔচিত্য-অনৌচিত্য প্রভৃতি
লক্ষণ ও নিয়ম নির্ণয়ের চেষ্টা করে।
ইসলামী আখলাক বা নৈতিকতা মানুষের হৃদয়মনকে
স্বার্থপরতা, আত্মম্ভরিতা, অত্যাচার, অবিচার, নির্লজ্জতা, অসংলগ্নতা, উছশৃংখলতা হতে
পরিশুদ্ধ বা পবিত্র করে দেয়, এবং হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয়,
বা
১২. মুহাম্মদ শাহজাহান আল ফারাবির
দার্শনিক চিন্তা ধারা বালো একাডেমী ঢাকা ২০০৪ পৃ. ৬৮।
১৩. আল কুরআন ৬৮: ৪
১৪. আল কুরআন ২৬: ১৩৭
তাকওয়া, সত্যবাদিতা ও সত্য প্রিয়তা,
ন্যায়বোধ, মহানুভবতা, উদারতা জাগিয়ে তোলে। তাকে নৈতিক দায়িত্ববোধ ও আত্মসংযমে অভ্যস্ত
করে তোলে। সৃষ্টিজগতের সকল সৃষ্টির প্রতি তাকে দয়াবান, সৌজন্যশীল, অনুগ্রহ সম্পন্ন,
সহানুভূতিপূর্ণ, বিশ্বাস ভাজন, স্বার্থহীন, সদিচ্ছাপূর্ণ, নিষ্কলুষ, নির্মল ও নিরপেক্ষ
ন্যায় বিচারক হিসেবে গড়ে তোলে। ইসলামী নৈতিকতা বা আখলাকের চর্চায়রত ও ব্রত ব্যক্তিটির
মধ্যে এমন এক উচ্চ পবিত্র (High sacred) স্বভাব প্রকৃতি লালিত পালিত হতে
থাকে, যার নিকট সবসময় কল্যাণেরই আশা করা যায়।
ইসলাম এবং ইসলামী নৈতিকতার মূল উদ্দেশ্যই
হচ্ছে মৌলিক মানবীয় চরিত্রে ভূষিত এবং জাগতিক শক্তি ধারী ও নৈতিকগুণাবলী সম্পন্ন একটি
সুসংগঠিত জনগোষ্ঠী তৈরী করা। যাতে ব্যক্তি নিজে, পরিবার ও সমাজ উপকৃত হতে পারে।
মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআ'লা দুনিয়ার
নেতৃত্ব কর্তৃত্ব ও তাদের হাতে দান করেন যারা তুলনামূলক অন্তত: মৌলিক মানবীয় চরিত্রে
ভূষিত, এবং যারা পৃথিবীতে আল্লাহর সৃষ্টি জগতের উপায়-উপকরণ (Meterial)
ব্যবহার করার দিক দিয়ে অগ্রসর, এটি হচ্ছে স্রষ্টার পক্ষ থেকে দুনিয়ার নেতৃত্ব পরিবর্তনের
স্থায়ী নীতি।
কিন্তু পৃথিবীতে যদি এমন কোন জনগোষ্ঠী
যারা মৌলিক মানবীয় চরিত্র এবং ইসলামী নৈতিকতা উভয় দিক দিয়ে অন্যান্য দলের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ,
বিদ্যমান থাকে অর্থাৎ জাগতিক শক্তি বা জড়শক্তি প্রয়োগ ও ব্যবহারে যারা অন্যান্য জাতির
তুলনায় পশ্চাৎপদ নয় তাহলে এধরনের জনগোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা অর্পণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কেননা এমতাবস্থায় কাফের মুশরিকদের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া আল্লাহর বিধান হতে পারে না।
এ বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে কোন ব্যক্তি সৎ হলে অথবা বিচ্ছিন্নভাবে অসংখ্য ব্যক্তির সৎ ও
যোগ্য হওয়া আল্লাহর নেতৃত্ব পরিবর্তনের নিয়মে বিন্দুমাত্র ব্যক্তিক্রম হতে পারে না।
এক্ষেত্রে প্রয়োজন সংঘবদ্ধতা, বা জামাত বদ্ধ জীবন যাপনকারী সৎ ও যোগ্য ব্যক্তির। আমরা
জানি লোহা, রড, সিমেন্ট, ইট, পাথর, চুন, টাইলস এগুলো ইমারাত বলা হয় না অথবা বিচ্ছিন্নভাবে
কোথাও পড়ে থাকলে অলৌকিকভাবে ইমারত নির্মাণ হবে না বরং এগুলোকে একত্রিত ও সংঘবদ্ধ করে
একটা রূপ দান করতে পারলেই কেবল একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ হতে পারে। মহানবী এজন্যেই
বলেছেন لَا إِسْلَامَ إِلَّا بِالْجَمَاعَةِ সংঘবদ্ধতা ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব
নেই।
এধরনের সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীকে আলকুরআনে
(خير امة) সর্বোত্তম জাতি বলা হয়েছে-
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ .
তোমরাই শ্রেষ্ঠজাতি তোমাদেরকে মানুষের
কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। (তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে) তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে অন্যায়
কাজে বারণ করবে।১৫
পবিত্র কুরআনে আবার এধরনের জাতিকে
(أُمَّةَ وَسَطًا) মধ্যম পন্থা অনুসরণকারী জাতি বলেও
উল্লেখ করা হয়েছে-
وَكَذَلِكَ جَعَلْتُكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا .
আর এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী
সম্প্রদায় করেছি যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষ্যদাতা আর রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষ্যদাতা
হন।১৬
অন্যত্র বলা হয়েছে-
وَمِمَّنْ خَلَقْنَا أُمَّةٌ يَهْدُونَ بِالْحَقِّ وَبِهِ يَعْدِلُونَ .
যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে এমন
সম্প্রদায় ও রয়েছে। যারা সৎপথ প্রদর্শন করে এবং তদনুযায়ী ন্যায় বিচার করে।১৭
অতএব ইসলামী নৈতিকতা ও এর উপাদান সমূহ
পৃথকভাবে আলোচনার দাবী রাখে। নিম্নে ইসলামী আখলাকের কয়েকটি উপাদান আলোচনা করা হলো:
নৈতিকতার প্রধান ভিত্তি বা উপাদান
‘তাকওয়া’
(Fear of Allah/to be careful, to be devout, to be pious, to be
cautions)
নৈতিকতার প্রধান ভিত্তি হচ্ছে তাক্বওয়া।
'তাক্বওয়া' আরবী শব্দ। 'তাক্বওয়া' একটি বিশেষ গুণের নাম এটি কোন বাহ্যিক ধরণ-ধারণ এবং
বিশেষ কোন • আচার অনুষ্ঠানের নাম নয়। তাক্বওয়া
মূলত মানব মনের সেই অবস্থাকেই বলা হয় যা আল্লাহর প্রতি গভীর ভয়-ভীতি এবং প্রবল দায়িত্বানুভূতির
দরুন সৃষ্টি
১৫. সূরা আলে-ইমরান: ১১০
১৬. আল কুরআন সূরা আল-বাকারা, আয়াত:
১৪৩
১৭. সূরা আল আ'রাফ, আয়াত: ১৮১
হয়। এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে স্বতস্ফূর্তভাবে
আত্মপ্রকাশ করে। এরূপ অনুভূতি ও চেতনা যার মধ্যে তীব্রভাবে বর্তমান থাকবে তার হৃদয়-মন
জাগ্রত হবে, তার ইসলামী চেতনা তেজস্বী হবে, আল্লাহর মর্জির বিপরীত প্রত্যেকটি বিষয়
তার মনে অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করবে। আল্লাহ এবং রাসূলের অপছন্দনীয় সকল বিষয় তার রুচিতে
অসহ্য হয়ে উঠবে। সে আল্লাহর ভয় থাকার কারণে প্রকাশ্যে তো নয় বরং গোপনেও দুর্নীতি, অপরাধ,
অপকর্ম, করবেনা। অসংখ্য সুযোগ সুবিধা গ্রহনের অবাধ অনৈতিক পথ খোলা থাকলেও সে দিকে পা
বাড়াবেনা। এধরনের তাকওয়ার অধিকারী তথা মুত্তাকীদের দ্বারা সমাজ, দেশ উপকৃত হয়।
পবিত্র কুরআন মাযীদে এ ধরনের মুত্তাকী
লোকদের ব্যাপারে বলা হয়েছে:
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ.
‘যদি জনপদবাসী ঈমান আনে আর তাকওয়া
অবলম্বন করে তা হলে আমি ঐ জনপদ বাসীদের জন্য আকাশ এবং জমিনের বরকতের (কল্যাণ) সমস্ত
দুয়ার খুলে দেই।১৮
একজন মুমিনের জীবনের সকল ক্ষেত্রে
থাকবে আল্লাহ ও রাসূলের হুকুমের আনুগত্য, পরকালে জবাবদিহির ভয়- এ দু'টি বৈশিষ্ট্য একজন
মানুষকে পাপের পংকিলতা থেকে রক্ষা করতে পারে। এ জন্য পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা আল্লাহকে
ভয় করার মত ভয় করতে নির্দেশ দিয়েছেন:
تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ. يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ
‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে যেমন ভয় করা
উচিত ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করে না।১৯
ইসলামের দৃষ্টিতে তাকওয়াই হচ্ছে নৈতিকতার
মূল ভিত্তি বা উপাদান। তাকওয়াবিহীন ব্যক্তি যে কোন সময় অপরাধ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি
সহ যে কোন অনাচারে জড়িয়ে পড়তে পারে। পবিত্র কুরআনে তাকওয়ার গুণকে বিশেষভাবে গুরুত্ব
প্রদান করা হয়েছে।
১৮. আল কুরআন ৭: ৯০
১৯. আল কুরআন ২: ১৫২
ইসলামী মূল্যবোধ
ইসলামী মূল্যবোধ বলতে ইসলাম প্রবর্তিত
ধর্মপ্রসূত বোধকেই বুঝায়, যার উৎস আসমানী কিতাব, বর্তমানে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ।
ইসলামী মূল্যবোধের মূলকথা হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ অনুসৃত নীতিমালার আলোকে ব্যক্তিগত
জীবন, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক, জীবন পরিচালিত হবে।
ইসলামী মূল্যবোধ ৪টি মৌলিক বিষয়ের
উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।
(১) নির্ভেজাল বা বিশুদ্ধ আকীদা বিশ্বাস/তাওহীদি
চেতনা
(২) দ্বীনের উপর গভীর ও সঠিক জ্ঞান।
(৩) পরিশুদ্ধ আত্মা।
(৪) সমাজের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য
এবং সামাজিক আচরণ পদ্ধতি সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জন ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে এর অনুশীলন।
মনে রাখতে হবে ইসলামী চিন্তা ধারা
এবং মূল্যবোধ কোন দার্শনিকের বা পণ্ডিতের বা গণকের বা জ্যোতিষির গবেষনার ফসল নয়। ইসলামের
মৌলিক দর্শন কোন কবির কল্পনা নয়। ইসলামী ভাবধারা বিশ্বজগতের স্রষ্টা মহান রাব্বুল আ'লামিনের
পক্ষ থেকে নির্ভুল জ্ঞান বা অহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত, মহানবী মুহাম্মদ আনিত জীবন দর্শনের
নাম, যা পৃথিবীর জ্ঞানীগুণী, দার্শনিক, বিজ্ঞানীগণ এটিকে বিজ্ঞান ভিত্তিক জীবন দর্শন,
হিসেবে এবং কুরআনকে মূলমন্ত্র গাইড বুক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। পবিত্র কুরআনের
নির্ভুলতা, গ্রহণযোগ্যতা থেকে প্রমাণিত কুরআন মানব রচিত গ্রন্থ নয়। কেউ স্বীকার না
করলেও এটি প্রমাণিত সত্য।
মহান আল্লাহ বলেন:
وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ
مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ.
নিশ্চয়ই এই কিতাব সম্মানিত গ্রন্থ
তাতে বাতিল (মিথ্যা, অসত্য, পথভ্রষ্টতা) সম্মুখ ভাগ ও পেছনের কোন দিক থেকে আসতে পারে
না। এটা হচ্ছে মহাবিজ্ঞ সুপ্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।৪
এই কুরআন সম্পর্কে বিশ্বজগতের স্রষ্টা
নিজেই ঘোষণা করেছেন-
- يُسَ وَالْقُرْآنِ الْحَكِيمِ ইয়াছিন বিজ্ঞানময় কুরআনের শপথ।৫
৪. সূরা হামীম আসসিজদাহ: ৪১-৪২।
৫. ৩৬-সূরা ইয়াসিন ১-২।
ইসলামী মূল্যবোধের রূপায়ন
যে কোন মূল্যবোধের বিকাশের জন্য অনুকূল
পরিবেশ ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা অনস্বিকার্য, ইসলামী মূল্যবোধের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।
অর্থাৎ ইসলামী আকীদা বিশ্বাস, বা ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি, ইসলামী আইনের আলোকে যখন
সমাজ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হবে তখনই কেবল ইসলামী মূল্যবোধের পূর্ণাঙ্গ রূপায়ন সম্ভব
হবে। মহানবী মুহাম্মদ এর মদীনা রাষ্ট্র এবং পরবর্তীতে চার খলিফা এবং উমর ইবনে আবদুল
আজিজের শাসনামল পর্যন্ত ইসলামী মূল্যবোধের বাস্তব প্রতিফলন সমাজে হয়েছিল। এর পর ধীরে
ধীরে রাজতন্ত্র, রাজা বাদশার স্বৈরশাসন, উমাইয়া, আববাসীয়াদের সময় আংশিক ইসলামী মূল্যবোধ
সমাজে বিদ্যমান ছিল। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধু বিজিত হওয়ার
পর এবং ১৭৫৭ এর পলাশী বিপর্যয়ের পূর্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ এক হাজার বছর উপমহাদেশে মুসলিমরা
রাজত্ব করেছিল, কিন্তু তারা ইসলামী মূল্যবোধের পরিপন্থি তথা ভোগ বিলাসের জীবন যাপন
করেছিল। ইসলামী মূল্যবোধ লালন করেনি, কোন কোন রাজাবাদশাহ ফেরাউনী চিন্তাধারায় দেশ শাসন
করেছিল। মোগল সম্রাট আকবর, ইসলামের নিরংকুশ তাওহীদি চেতনাকে ধুলিসাৎ করে "দ্বীনে
ইলাহী" নামে শিরক মিশ্রিত জীবন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, পারস্যের অগ্নি উপাসকদের
অনুসরণে দর্শনার্থীদের থেকে (সিজদা-ই-তাহিয়্যা) সম্মানসূচক সিজদা আদায় করতেন। সবশেষে
বৃটিশ শাসন এর অবসানের পর মুসলমানরা ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার দাবীতে পাকিস্তান গঠন করলেও
নেতারা ইসলামী মূল্যবোধ ও ইসলামী সমাজ গঠন না করে মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করেছে।
পাকিস্তান গেল, স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। এখানে যারা ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে
সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখছেন তারা এখনও জনগণের নিকট সার্বিক দিক থেকে আস্থা অর্জন করতে
পারেননি। ইসলামী আদর্শবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হলে এর ধারক বাবহকদেরকে চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যে
সুনাগরিক, বিশ্বস্ত, চরিত্রবান ও সুযোগ্য হতে হবে। নইলে ইসলামী সমাজ স্বপ্নই থেকে যাবে।
কেননা নৈতিকতা, সততা ও যৌগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ না হলে মহান আল্লাহ ইসলামী সমাজ
ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য খেলাফত বা রাষ্ট্র ক্ষমতা দেননা। বরং জালেমের শাসন দ্বারা
তাদের পরীক্ষায় ফেলেন। দুরাচার, অসৎ নেতৃত্ব, জালেমকে অসচেতন, বেখবর নাগরিকদের উপর
চাপিয়ে দেন যাতে তারা সচেতন হয়। (চলবে)
সুত্রঃ নৈতিকতা ও মূল্যবোধ
নওয়াব নুসরত জং
১৭৫৯ (?)- ১৮২২ খৃঃ
ঢাকার নায়েব নাযিম নওয়াব হাশমত জং
সৈয়দ মুহম্মদ খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছোট ভাই ইনতিযামুদ দৌলাহ, নাসীরুল মুল্ক সৈয়দ আলী
খান- বাহাদুর নওয়াব নুসরত জং ১২০০ হিজরী* মুতাবিক ১৭৮৬ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি
মুতাবিক ১১৯২ বংগাব্দের ২২শে মাঘ গভর্নর জেনারেলের অনুমোদনক্রমে নায়েব নাযিম নিযুক্ত
হন এবং আমরণ ৩৭ বছর প্রভাব ও গৌরবসহকারে ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।১ ১২৩৭ হিজরীর
১লা যুলকা’দা মুতাবিক ১৮২২ সালের ২১শে জুলাই রোববার তিনি রক্ত-আমাশয়ে চাকায় ইনতিকাল২
করেন এবং ঢাকার হুসাইনী দালানস্থ ইমামবাড়ায় সিঁড়ির সন্নিহিত পূর্ব পার্শ্বে সমাধিস্থ৩
হন। তাঁর পিতা ছিলেন মীর মুরতাযা, যিনি আরবদেশ থেকে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
নুসরত জং অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও ভাগ্যবান
লোক ছিলেন। তাঁর হিতকর কার্যে জনগণ উপকৃত হয়। ধনী-গরীব সকলেই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ ও তাঁর
প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। আপামর জনসাধারণের সাথে তিনি হাসিমুখে কথাবার্তা বলতেন। ভিক্ষুকদের
প্রতি তিনি সদয় ছিলেন। আল্লাহভীরুতা ছিল যেন তাঁর সহজাত বস্তু। তাসবীহ, কুরআন ও ওয়াযীফা
পাঠে তিনি প্রায়শ মশগুল থাকতেন। বংশের দিক থেকে তিনি ছিলেন হুসাইনী সৈয়দ
* Nusrat Jang, Tarikh-i-Nusrat
Jangi, Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. II, No. 6, p. 135
১. রহমান আলী, তায়েশ, তওয়ারীখ-এ-ঢাকা,
আরা ১৯১০, পৃঃ ১৫৭-৫৮
২. ঐ, পুঃ ১৫৯ (পাদটীকা)
৩. Aulad Hasan, Sayed, Notes on
the Antiquities of Dacca, Dacoa, N! 1904, p. 18
এবং ধর্মীয় মতবাদের দিক থেকে ছিলেন
শিয়াপন্থী। তিনি ঢাকার শিয়া সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিতেন। তাঁর নানা জাসারত খান ইরানের
কুম্ শহরের এক মুজতাহিদের পুত্র ছিলেন, যিনি নওয়াব হুসাইনুদ্দীন খানের শাহাদত বরণের
পর ১১৬৮ হিঃ/১৭৫৪ খৃঃ নায়েব নাযিম নিযুক্ত হয়ে ঢাকায় আগমন করেছিলেন।১ শিয়াপন্থী
হওয়া সত্ত্বেও ঢাকার মগবাজার-দায়রার সুন্নী গদ্দীনশীন হযরত শাহ্ মুহম্মদীর (মৃঃ ১২৫১/১৮৩৫)
প্রতি নুসরত জং-এর প্রগাঢ় ভক্তি ও আন্তরিক শ্রদ্ধা ছিল।২ তিনি একজন ধর্মপরায়ণ
লোক ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের কাছে লক্ষিয়া নদীর পূর্বদিকে অবস্থিত ‘কদমরসুলের দরগাহ্’র
প্রতি তিনি যত্নবান ছিলেন। তিনি মাঝে মধ্যে কদমরসূল-মসজিদে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করতেন
এবং ইবাদতে মশগুল থাকতেন। সেখানে অবস্থানের জন্য তিনি ঘরদোরও প্রস্তুত করেছিলেন।৩
শহরের শীর্ষস্থানীয় অধিবাসিগণ নুসরত জং-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সন্তুষ্ট ছিলেন। ইংরেজ
কর্মকর্তাদের সাথে আগাগোড়াই তাঁর সম্ভাব ছিল। তিনি তাঁদের মন যুগিয়ে চলতেন। কম্পানি-গভর্নমেন্টের
কাছে তার বেশ সুনাম ছিল।৪ এটা জানা কথা যে, ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি
দিল্লীর সম্রাট দ্বিতীয় শাহ্ আলম (১৭৫৯-১৮০৬) থেকে বাংলার দেওয়ানী লাভ করেন এবং লেফটেন্যান্ট
সুইন্টন ঢাকায় এসে নায়েব নাযিম জাসারত খান থেকে দেওয়ানী তথা রাজস্ব বিভাগের দায়িত্ব
গ্রহণ করেন। এ সময় থেকেই নওয়াব নাযিম ও নায়েব নাযিমদের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয় এবং তাঁরা
পেনশনভোগী নওয়াবে পরিণত হন। পদাধিকার-বলে মহৎ কিছু করার সুযোগ তাঁদের ছিল না। তাঁদের
নওয়াবী, মানইজ্জত ও শান-শওকত পূর্ববৎ ছিল বটে, কিন্তু আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা তাঁদের
ছিল না বললেই চলে। তদানীন্তন কালেক্টর ডি’ ওইলি নুসরত জং-এর শাসনক্ষমতা সম্পর্কে বলেন:
The naib nazim has now no share whatever in the local
administration, the whole internal arrangement of the concerns of the Province
being in the hands of the Company.৫
১. Nusrat Jang, op. cit, p. 134
২. রহমান আলী, তায়েশ, পূর্বোক্ত, পৃঃ
১৫৮
৩. ঐ, পৃঃ ২৯৪-৯৮। Taifoor, Syed, Muhammad, op. cit, p. 298
৪. রহমান আলী, তায়েশ, পূর্বোক্ত, পৃঃ
১৫৯
৫. D’Oyly, Charles, Sir, Antiquities of Dacca, London, n. d., p. 18
এমতাবস্থায় নুসরত জং-এর সম্মান ও মহত্ত্বের
মূল্যায়ন করতে হবে তাঁর মানবিক গুণাবলী ও অন্যান্য ব্যক্তিগত কার্যাবলীর আলোকে।
মুর্শিদাবাদের নওয়াব নাযিম মুবারকুদ্
দৌলাহ্ (মৃঃ ১৭৯৭) কাছেও নুসরত জং-এর বিশেষ সম্মান ছিল। তিনি তাঁর ছোট ভাই শামসুদ্দৌলাহকে
মুর্শিদাবাদের উক্ত নওয়াবের কন্যা (বরুন নিসা)-কে বিয়ে করান (১৭৮৯)। সেই বিয়েতে নুসরত
জং-এর খুবই শোহরত হয়। এই বিয়ে উপলক্ষে তিনি মুশিদাবাদে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। মুশিদাবাদের
নওয়াবও ঐ বিয়েতে বড় বড় উপঢৌকন প্রদান করেন।১
নওয়াব নুসরত জং ছিলেন একাধারে নামযাদা
প্রশাসক, শিক্ষাগুরু, লিপি-বিশারদ ও চারুকলাপ্রিয়। তাঁর আরবী-ফার্সী হস্তলিপি ছিল চমৎকার।
তিনি প্রায়শ সুন্দর হরফে স্বহস্তে লিখিত কিতাব পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতেন।২
কারণ তখনো ঢাকায় আরবী-ফার্সীর কোন প্রেস স্থাপিত হয় নি। তাঁর চমৎকার ফার্সী লিপির দু'-চারটি
নমুনা এখনো কালের গ্রাস থেকে বেঁচে রয়েছে। হাকীম হাবীবুর রহমানের পুত্র হাকীম হুসামুর
রহমানের নিকট তাঁর দু'টি রঙ্গিন হস্তলিপি সংরক্ষিত আছে। নওয়াব নুসরত জং-এর দরবারে অনেক
নিপুণ চিত্রকর ছিল। তন্মধ্যে আলম নামক চিত্রকরের বিশেষ খ্যাতি ছিল। ঐ দরবারের একজন
চিত্রশিল্পী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এক মুহররম- মিছিলের যে প্রখ্যাত জলরং চিত্রটি এঁকেছেন,
তাতে আদ্যোপান্ত মিছিলটির পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপ বিধৃত হয়েছে।৩ নুসরত জং ও তাঁর
উত্তরসুরি নায়েব -নাযিমদের সময় অঙ্কিত চিত্রসমূহকে মোগল যুগীয় চারুকলার শেষ নিদর্শন
বলা যেতে পারে। এ সময়কার চারুকলার কিছু নিদর্শন ঢাকার জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
নওয়াব নুসরত জং পাশ্চাত্য চিত্রকলার
ভক্ত ছিলেন। ঢাকা জেলার উক্ত কালেক্টর স্যার চার্ল ডি’ ওইলী আনুমানিক ১৮১৯ খৃঃ নওয়াব
সাহেবের
১. রহমান আলী, তায়েশ, পূর্বোক্ত, পৃঃ
১৫৮
২. Bangladesh Distriot Gazetteer, Dacca 1975, p. 117
৩. রহমান আলী, তায়েশ, পূর্বোক্ত, পৃঃ
১৫৮
৪. রফিকুল ইসলাম, ঢাকার কথা, আহমদ
পাবলিশিং হাউস, ঢাকা ১৯৮২, পৃঃ ১০৬। Taifoor,
Muhammad, Syed, Glimpses of Old Dhaka, Dhaka 1985 p. 236
সাথে তাঁর বাসভবনে দেখা করেছিলেন।
তখন নওয়াব সাহেবের বয়স ছিল ৬০ বছর। ডি’ ওইলী দেখতে পেলেন যে, নওয়াব সাহেবের নিমতলীস্থ
প্রাসাদটি প্রাচ্য-রীতিতে সাজানো হলেও তাঁর দরবার কক্ষের দেয়ালগুলো ছিল পাশ্চাত্যের
আধুনিক চিত্রসম্ভারে সুশোভিত। নওয়াব সাহেবের ললিতকলা-প্রীতি, তাঁর মহানুভবতা, অমায়িক
আচার-ব্যবহার এবং তাঁর দরবারের সমারোহ বর্ণনা
করে ডি' ওইলী বলেন:
He is a man of mild deportment,
universally esteemed for the urvanity of his manners, and the benevolence of
his heart. He, moreover, possesses considerable taste for the fine arts. He
resides at Daoca in a palace very splendidly ornamented in the oriental manner,
and his audience-chamber is so crowded with English prints and paintings, that
not an inch of the walls can be seen. In all his visits of ceremony. Nusrat
Jung is attended by an immense train of horsemen and other followers.১
ফার্সী ভাষায় রচিত নুসরত জং-এর 'তারীখ-এ-জাহাংগীর
নগর ঢাকা ওরফে ‘তারীখ-এ-নুসরত জংগী’ একটি ক্ষুদ্র পুস্তক হওয়া সত্ত্বেও এটি তাঁকে ঢাকায়
মোগল-শাসন ও মোগল-স্থাপত্যের অন্যতম আদি ইতিহাস-লেখকরূপে অমর করে রেখেছে। এই লেখায়
তাঁর মুসলিম স্থাপত্য-প্রীতির পরিচয় মেলে। এ পুস্তিকাটির প্রণয়নের ঠিক তারিখ নির্ণয়
করা কঠিন। তবে এতটুকু নিশ্চিত- ভাবে বলা যায় যে, ১৭৮৫ সালের পর এবং ১৮১৭ সালের পূর্বে
কোন এক সময় এটি রচিত হয়। ১৮২০ সালের ১১ অক্টোবর লেফটেন্যান্ট সুইন্টন এ পুস্তিকার যে
পাণ্ডুলিপি কলকাতার ‘বেংগল এশিয়াটিক সোসাইটি’র গ্রন্থাগারে প্রদান করেছিলেন, তার শেষ
পৃষ্ঠায় এই কথাগুলো লেখা ছিল: Account of Dacca by the
Nawab Nusrat Jung, the Present Nawab of that city, 1817.
‘তারীখ-এ-নুসরত জংগী’ পুস্তিকায় মোগল
সম্রাট আকবর (১৫৫৬- ১৬০৫) থেকে আরম্ভ করে বাংলার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সুবাদার কুতবুদ্দীন
খান, শাহযাদা আযীমুশ্-শান, মুর্শিদকুলি খান, শাহ শুজা, মুআযযম খান, আলীবর্দী খান, সিরাজুদ্দৌলাহ
এবং তা ছাড়া ঢাকার নায়েব নাযিম-নওয়াব জাসারাত খান, নওয়াব হাশমত জং ও নওয়াব নুসরত জং-এর
শাসন ক্ষমতা
১. D' Oyly, op.cit, P. 18
প্রাপ্তি পর্যন্ত ঢাকা তথা বাংলার
সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। নুসরত জৎ তাঁর রচনার শেষলগ্নে ঢাকার
কতক পুরনো প্রাসাদ, পুল, মসজিদ, গোরস্থান, কামান ইত্যাদি কোন্ সময়, কোথায় ও কোন্ ব্যক্তি
কর্তৃক নিমিত বা স্থাপিত হয়েছে, সে সবের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন। কতক ইংরেজ বন্ধুর
অনুরোধে তিনি এ পুস্তিকাটি রচনা করেছেন বলে এর ভূমিকায় উল্লেখ করেন।
নওয়াব নুসরত জং-এর ‘আর দ বেগী’ সৈয়দ
মুহম্মদ হুসাইন খান আল- হুসাইনীর পুত্র সৈয়দ আবদুল গনী ওরফে হামীদ মীর নুসরত জং রচিত
“তারীখ-এ-জাহাংগীর নগর ঢাকা”-এর মূল অংশের সংগে নুসরত জং-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী জুড়ে দেন
এবং ঢাকার পরবর্তী নায়েব নাযিম নওয়াব শামসুদ্ দৌলাহ (১৮২২-১৮৩১), নওয়াব কমরুদ্ দৌলাহ
(১৮৩১-১৮৩৪) ও নওয়াব গাষীউদ্দীন মুহম্মদের (১৮৩৪-১৮৪৪) মৃত্যু পর্যন্ত শাসন-আমলের সংক্ষিপ্ত
ইতিবৃত্তও অন্তর্ভুক্ত করেন। হামীদ মীর শামসুদ দৌলাহর ইতিবৃত্ত পেশ করতে গিয়ে তাঁর
প্রণীত বৃটিশ শাসন উৎখাতের পরিকল্পনাটিও তুলে ধরেন। ঐ উদ্দেশ্যে অযোধ্যার শাসনকর্তা
ওয়াযীর আলী খানবাহাদুর ও পার্শ্ববর্তী রাজাদের সাথে শামসুদ্ দৌলাহর পত্র-যোগাযোগ,
ঐ ব্যাপারে সহায়তা প্রদানের জন্য ফরাসীদের সাথে তাঁর যোগসূত্র স্থাপন এবং ঐ পরিকল্পনা
ফাঁস হওয়ার পর বৃটিশ সরকার কর্তৃক কলকাতায় তাঁর ‘সাত বছর’ অন্তরীণ হওয়ার বিষয়- সমূহও
হামীদ মীর উল্লেখ করেন।
নাযিম ও নায়েব-নাযিমদের বিবরণ প্রদানের
পর হামীদ মীর, নুসরত জং-এর মৃত্যুকাল (১৮২২) থেকে গাযী উদ্দীনের মৃত্যু (১৮৪৪) পর্যন্ত
২২ বছর সময়ে ঢাকায় ও তার চতুষ্পার্শ্বস্থ এলাকায় যে সব জমিদার বা রইস মৃত্যুবরণ করেন,
তাঁদের একটি সংক্ষিপ্ত খতিয়ান উপস্থিত করেন। এ প্রসংগে তিনি ঢাকার জমিদার মীর আশরাফ
আলী, আবদুল্লাপুর ও আটিয়া পরগনার জমিদার মীর নওয়াব, বলদাখাদ পরগনার জমিদার মির্যা মুহম্মদ
কাযেম, বালিয়াটির জমিদার মীর আতাউর রহীম, মজলিসপুরের জমিদার মির্ষা হাসান আলী, ফুলুওয়া
(বাকেরগঞ্জ) পরগনার জমিদার মির্যা হায়দার আলী প্রমুখের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও তাঁদের চারিত্রিক
গুণাবলী তুলে ধরেন।
হামীদ মীর তাঁর স্বীয় সংযোজনের সময়
নুসরত জং লিখিত ঢাকার প্রত্ন- তাত্ত্বিক বিবরণ-সংবলিত অধ্যায়টিকে পুস্তিকাটির সর্বশেষে
স্থান দেন। হামীদ মীরের সংযোজিত অংশটি পাঠ করলে তাঁর পেশ করা কোন কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে
প্রতীয়মান হবে যে, এটি তিনি নওয়াব গাযীউদ্দীনের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই মূল বইয়ের অন্তর্ভুক্ত
করেছিলেন।
‘তারীখ-এ-নুসরত জংগী’ নিছক সাহিত্য-মূল্যের
দিক থেকে তেমন গুরুত্বের অধিকারী না হলেও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর মূল্য অনস্বীকার্য।
কোন কোন ঐতিহাসিক এর গুরুত্ব স্বীকারও করেছেন। প্রখ্যাত প্রাচ্যভাষাবিদ এইচ. ব্লকম্যান
(১৮৩৮-১৮৭৮) কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে এ পুস্তিকাটির পাণ্ডুলিপি পাঠ করেন এবং এর
শেষলগ্নে ঢাকার কতক পুরাকীর্তির যে প্রত্নতাত্ত্বিক বর্ণনা রয়েছে, তা ফলপ্রসূ বলে মন্তব্য
করেন। কিন্তু অপর যে অংশটিতে বাংলার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস স্থান লাভ করেছে,
সে সম্পর্কে তিনি ‘good for nothing’ বলে মত প্রকাশ করেন (১৮৭০)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০
পৃষ্ঠা (৯”/৫.৫”) সংবলিত এই পুস্তিকাটির একটি ফটো- কপি সংরক্ষিত রয়েছে। এর শীর্ষ পৃষ্ঠায়
এইচ, ব্লকম্যানের দস্তখতসহ উক্ত মন্তব্যটি পরিলক্ষিত হয়। এর মূল কপি রয়েছে কলকাতার
‘বেংগল এশিয়াটিক সোসাইটি’তে।
এ পুস্তিকাটি মোটামুটি এক শতাব্দীকাল
অপ্রকাশিত ছিল। প্রাচ্যভাষাবিদ হরিনাথ দের সম্পাদনায় ১৯০৮ সালে কলকাতার ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’
পত্রিকায় এটি ‘তারীখ-এ-নুসরত জংগী’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।১ হরিনাথ দে ব্লকম্যানের
উক্ত মন্তব্যের সাথে একমত হতে পারেন নি। এই সংস্করণে নুসরত জং-এর মূল পুস্তিকার সংগে
সৈয়দ আবদুল গনী ওরফে হামীদ মীরের সংযোজনটিও স্থান লাভ করেছে। সোসাইটি-পত্রিকায় এর কলেবর
ছিল ৩৩ পৃষ্ঠা (পৃঃ ১২১-১৫৩)।
হাকীম হাবীবুর রহমান মনে করেন, বর্তমানে
ঢাকার বখশীবাজারে যে 'হুসাইনী দালান' রয়েছে, তা নওয়াব নুসরত জং কর্তৃক নির্মিত হয়।
সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে, শাহ শুজার সুবাদারীর সময় ১০৫২ হিঃ। ১৬৪২ খৃঃ তাঁর নৌবহর-প্রধান
সৈয়দ মীর মুরাদ কর্তৃক দালানটি নিমিত হয়। দালানটির পূর্বদিক থেকে দোতলা পর্যন্ত বিস্তৃত
সিঁড়ির উপরে দেয়ালের গায়ে যে শিলালিপিটি আছে, তাতে অনুরূপ নাম ও তারিখই খোদিত রয়েছে।
কিন্তু
১. Memoirs of the Asiatic Society
of Bengal, Vol. II, No 6, Pp. 121-153
হাকীম সাহেবের মতে, মীর মুরাদ নামক
কোন এক ব্যক্তি বাদশাহ্ আলম- গীরের সময় এদিকে কোথাও হয়তো ছোট একটি 'তাযিয়াখানা' নির্মাণ
করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে বিলুপ্ত হয়ে থাকবে। স্থানীয় জনশ্রুতির উপর ভিত্তি করে হাকীম
সাহেব বলেন, নওয়াব নুসরত জং-ই দোতলা বিশিষ্ট বর্তমান হোসাইনী দালানটি নির্মাণ করেন
এবং মীর মুরাদের নামে একটি 'শিলালিপি ঐ দালানের গায়ে জুড়ে দেন। এ দালানটি আলমগীরের
আমলে মীর মুরাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় নি, বরং বৃটিশ-আমলে নুসরত জং-ই এটি নির্মাণ করেন-এ
বিষয়টি প্রতিপ্রন্ন করার জন্য হাকীম মরহুম তাঁর ‘আসুদগান-এ- ঢাকা’ গ্রন্থে বিভিন্ন
প্রমাণ উপস্থাপিত করেন। ১ মুহম্মদ তৈফুর বলেন, শাহাজাদা শুজার সময় মীর মুরাদ নামে কোন
নওয়ারা-প্রধান ছিল না। ১৭২৬-২৭ খৃঃ মৃত্যুবরণকারী মীর মুরাদ নামক যে লোকটির মৃত্যু-তারিখ
হুসাইনী দালানের পূর্বপার্শ্বস্থ দেয়ালের নিম্নাংশে একটি শিলালিপিতে খোদিত রয়েছে,
'তিনি নিশ্চয়ই অন্য ব্যক্তি ছিলেন। তিনি হয়তো ‘প্রাইভেট ইমামবাড়া’ রূপে এখানে ছোট একটি
দালান নির্মাণ করেছিলেন, যা আঠার শতকের শেষের দিকে 'পাবলিক ইমামবাড়া'রূপে বর্তমান অবস্থায়
উন্নীত ও পুননির্মিত হয়। সৈয়দ আবদুল গনী ওরফে হামীদ মীর 'তারীখ-এ-নুসরত জঙ্গী'র সংযোজিত
অংশে বলেন, শাহযাদা মুহম্মদ আযমের (১৬৭৭-১৬৭৯) সুবাদারীর সময় রাজকীয় পূর্ত বিভাগের
মীর (প্রধান) সৈয়দ মীর মুরাদ ‘পবিত্র হুসাইনী দালান’টি নির্মাণ করেন।৩
১. আসুদেগান-এ-ঢাকা, পূর্বোক্ত, পৃঃ
১৪২-৪৪
২. Taifoor, Muhammad, Syed, op. ait, p. 263
৩. Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. II, No 6, p. 152
সূত্রঃ বই ঢাকার কয়েকজন মুসলিম সূধী
ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাছ
পৃ- ৩-৯