হিন্দু-মুসলিম রাজনীতি ও ইতিহাসের গতিধারা

০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এক.

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো। ইতিহাসে লেখা রয়েছে- পাকিস্তানের জন্ম হয় দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। অন্য কথায়, তখন এই উপ-মহাদেশে বিদ্যমান ছিল দুটি জাতি। মুসলমানেরা একটি জাতি আর হিন্দুরা আর একটি জাতি। আত্মত্মনিয়ন্ত্রণের যে অমোঘ অধিকার, সেই অধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো। এই হলো ইতিহাসের সহজ সরল ব্যখ্যা। দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাংশের জন্যে এই তত্ত্ব কিছুটা সাযুয্যপূর্ণও বটে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের দু'জন নেতার বক্তব্য এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ১৯৪০ সালের জানুয়ারি মাসে একটি ইংরেজি পত্রিকায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বি-জাতি তত্ত্ব সম্বন্ধে বলেন: "ভারতে দুটি জাতি রয়েছে এবং মাতৃভূমির শাসন ব্যবস্থায় উভয় জাতির অবশ্যই অংশগ্রহণ করতে হবে" ['There are in India two nations who both must share the government of their common motherland']। তিনি আরো বলেন, "হিন্দু-মুসলিমদের ধর্মীয় দর্শন, সামাজিক রীতিনীতি ও সাহিত্য পৃথক ও স্বতন্ত্র। তারা পরস্পর বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয় না অথবা একত্রে আহার্য গ্রহণ করে না। মূলত তাদের সভ্যতা স্বতন্ত্র ও ভিন্নমুখী। তাদের জীবন-দর্শন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাদের মহাকাব্য ভিন্ন, তাদের বীর সেনানী স্বতন্ত্র। প্রায় একজনের বীর সেনানী অন্যদের শত্রু এবং তাদের জয়-পরাজয় এবং অনুরূপ বিষয়ও পরস্পর বিরোধী।"

 

অন্যদিকে, ভারতের কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী নেতা মাধব সদাশিব গোলওয়াকার বলেন, "হিন্দুস্তান হলো হিন্দুদের দেশ, এবং শুধুমাত্র হিন্দু জাতির অগ্রগতির আবাসভূমি" ["Hindustan is the land of the Hindus and is the terra firma for the Hindu nation alone to flourish"]। তিনি আরো বলেন, "ভারতে মুসলমানরা বিদেশীর মত, অনেকটা জবরদখলকারী অভিবাসীর মত। যত তাড়াতাড়ি তারা ভারত ছেড়ে চলে যায় ততই হিন্দুদের জন্যে মঙ্গল। তারা ভারত ছেড়ে চলে গেলেই ভারতে 'রামরাজ্য' প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

 

ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাংশের অবস্থা কিন্তু একটু ভিন্ন। ভিন্ন বলছি এজন্যে যে, এই অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহিষ্ণুতার বন্ধন বরাবর সুদৃঢ়। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং স্বতন্ত্র জীবন-দর্শন অক্ষুণ্ণ রেখেও তারা পরস্পরের কাছাকাছি থেকেছেন শান্তিতে। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও কিন্তু এই অঞ্চলের মুসলমান ও হিন্দুরা নিজেদের স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে পরিগণিত করে কখনো কোন আন্দোলন গড়ে তোলেনি। হিন্দু মহাসভার কিছু নেতার মধ্যে উগ্র হিন্দুত্ব প্রকাশ পেলেও মুসলমানদের মধ্যে তেমন উগ্রতার প্রকাশ দেখা যায়নি। বাংলার মুসলমানরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগদান করে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে বিপুলভাবে বিজয়ী করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলেন দ্বি-জাতি তত্ত্বে বর্ণিত স্বতন্ত্র মুসলিম জাতি হিসাবে নয়, বরং দীর্ঘকালীন পরিসরে সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত, নির্যাতিত জনসমষ্টি হিসাবে। নিজেদের ভাগ্য

পরিবর্তনের লক্ষ্যে। এর কারণও অবশ্য রয়েছে। ভারতবর্ষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আক্রান্ত হয়েছে। বিজিত হয়েছে। বাহির থেকে এসে বিজয়ীরা ভারতকে শাসন করেছে। এসেছে শক, হুন, পাঠান, মোগলরা। তাদের প্রায় সকলেই ভারতে প্রবেশ করেছে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে, স্থলপথে। ইংরেজদের আগমন ঘটে কিন্তু উত্তর-পূর্ব দিক থেকে, সমুদ্রপথে নৌ-শক্তির উপর ভর করে। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পরে মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিশাল ভারতের অধিকাংশে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে গড়ে তোলে এক বিশাল সাম্রাজ্য।

 

দুই.

উত্তর-পূর্ব ভারত, বিশেষ করে বাংলার একটা অতীত রয়েছে- একটা গৌরবময় অতীত। বর্তমানে বাংলাদেশ সম্পর্কে যারা সবচেয়ে বেশি খারাপ কথা উচ্চারণ করছেন, যারা বলছেন বাংলাদেশ একটা অ-কার্যকর অথবা প্রায় অ-কার্যকর রাষ্ট্র, যারা বাংলাদেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্রের কাতারে ফেলতে উদ্যত, যারা একদিন 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলে বাংলাদেশকে অপাক্তেয় করতে চেয়েছিলেন, তাদেরই পূর্বপুরুষরা বাংলাকে কী চোখে দেখেছেন তা সবার জানা উচিত। আঠার শতকের মাঝামাঝি বিশ্বের সর্বমোট উৎপাদনের সমীক্ষায় বলা হয়, তখন বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ভারতবর্ষ ও চীনেই সম্পন্ন হতো এবং ভারতবর্ষে যে পরিমাণ উৎপাদন হতো তার অর্ধেক যা বিশ্বের প্রায় সাড়ে বার কিংবা তের শতাংশ শুধু মাত্র বৃহত্তর বাংলায় সম্পন্ন হতো। আর বৃহত্তর বাংলা ছিল বাংলাদেশসহ পশ্চিম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশের ছোট নাগপুর এবং উত্তর-পূর্ব ভারত। অন্যদিকে, সমগ্র আঠার শতকব্যাপী বৃহত্তর বাংলা ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি। এখানে বাণিজ্য বহর নিয়ে এসেছে ব্রিটেনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ফ্রান্সের প্রাচ্য দেশীয় বাণিজ্য বহর, গুলন্দাজ বাণিজ্য জাহাজ, পর্তুগীজ বহর, এমন কী যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য পোত। ১৮৭৭ সালে লর্ড মেকলে (Macaulay) তার Critical and Historical Essays, 1877) গ্রন্থে লিখেছেন, "তৈমুর লং এর পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ভারতীয় জনপদের মধ্যে বাংলাই সবচেয়ে সমৃদ্ধ। ভারতের অন্য কোন অংশের কৃষি ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে এমন প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধা ছিল না। দূরবর্তী জনপদসমূহ বাংলার শস্য ভান্ডারের উদ্বৃত্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করেছে। এমন কী লন্ডন ও প্যারিসের অভিজাত মহিলারা বাংলায় প্রস্তুত সুকুমার পরিধেয় জড়িয়ে বর্ণালী হয়েছে" ["Of the provinces which had been subject to the house of Tamerlane the wealthiest was Bengal. No part of India possessed such natural advantages both for agriculture and for commerce....... distant provinces were nourished from the overflowing of its granaries, and the noble ladies of London and Paris were clothed in the delicate produce of its looms.']।

 

ষড়যন্ত্রমূলক পলাশী বিপর্যয়ের পরে বাংলা পড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবলে। যে কোন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চিরাচরিতভাবে যে দুটি পন্থা- অধিকৃত জনপদের সম্পদের নির্বিচার লুণ্ঠন এবং যাদের নিকট থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের ক্ষমতার ভিত্তিগুলিকে দুমড়ে মুচড়ে তছনছ করে তাদের সহায়-সম্বলহীন করে তোলা- ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তা গ্রহণে এতটুকু কসুর করেনি। পলাশীর যুদ্ধের পর পরই শুরু হয় বাংলার অফুরন্ত সম্পদের নির্বিকার লুণ্ঠন এবং স্বদেশে পাচার। ফলে বাংলার জনজীবনে শুরু হয় নিঃস্ব হবার অনতিক্রম্য প্রক্রিয়া, দারিদ্র্যের কষাঘাত, বাংলায় দুর্ভিক্ষের কাল। ১৭৫৭ সালের ২৬ জুনে হতভাগ্য সিরাজের জীবনাবসান ঘটলে, জুলাই মাসের ৩ তারিখে মীর জাফর যখন নবাবের তোষাখানা ক্লাইভের জন্যে উন্মুক্ত করেন তখন বাংলার নবাবের সম্পদ ভান্ডার দেখে ক্লাইভ মুচ্ছা যাবার উপক্রম হয়েছিলেন। অস্ফুট স্বরে শুধু বলেছিলেন: এও কী সম্ভব। কোন রাজন্যের একার এত সম্পদ থাকতে পারে। মেকলের নিজের কথায়: "সম্পদের ধারা বর্ষিত হলো কোম্পানি ও তার ভৃত্যদের উপর। আট লক্ষ পাউন্ড স্টারলিং মূল্যের সোনা চাঁদির মুদ্রা মুর্শিদাবাদ থেকে ফোর্ট উইলিয়ামে স্থানান্তরিত হলো। এই সম্পদ স্থানান্তরিত করতে ব্যবহৃত হয় শতাধিক নৌকা। বাংলার সম্পদ ভান্ডার যখন ক্লাইভের সামনে উন্মুক্ত হয় তখন তিনি রুবি এবং ডায়মন্ড খচিত স্বর্ণ ও রৌপ্যের স্তূপের মধ্যে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলেন এবং ইচ্ছামত রুবি ও ডায়মন্ড এদিক ওদিক ছিটিয়ে নিজের মত কবজা করলেন" ['The shower of wealth now fell on the company and its servants. A sum of eight hundred thousand sterling, in coined silver, was sent down the river from Murshidabad to Fort William. The fleet which conveyed this treasure consisted of more than hundred boats...... The treasury of Bengal was thrown open to Clive who walked between heaps of gold and silver crowned with rubies and diamonds and was at liberty to help himself."]

 

একদিকে নির্বিচার লুণ্ঠন, অন্যদিকে যাদের নিকট থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া হলো সেই মুসলিম সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলিম অভিজাত শ্রেণীকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবার উদ্যোগ গৃহীত হয় ঐ সময় থেকে যেন কোনদিন তারা আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। এই প্রক্রিয়া প্রায় সর্বত্র গৃহীত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারা। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, কোথাও এর ভিন্নতা দেখা যায়নি। কোন কোন স্থানে তাদের নির্মূলও করা হয়। দক্ষিণ এশিয়া অন্যান্য উপনিবেশ থেকে একটু স্বতন্ত্র হওয়ায়, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নত সংস্কৃতি, এখানকার সাধারণ মানুষ এবং অভিজাত শ্রেণী তুলনামূলকভাবে সচেতন ও ভিন্নধর্মী হওয়ায় তাদের নির্মূলকরণের পরিবর্তে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতে তাদের সাম্রাজ্যকে স্থায়ী করার লক্ষ্যে ডিভাইড এন্ড রুল (Divide and Rule) বা এক সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবার নীতি গ্রহণ করে।

 

এই নীতির ফলে বৃহত্তর বাংলার সাধারণ মানুষের জীবন হয় পর্যুদস্ত। বিশেষ করে মুসলিম অভিজাত শ্রেণী হয় পুরোপুরি বিধ্বস্ত। ১৭৫৭ সালের পূর্বে মুসলমানদের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল। তাদের সামাজিক মর্যাদাও ছিল তুলনামূলকভাবে উন্নত। শিক্ষা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যেও ছিলেন তারা বেশ অগ্রগামী।

 

বৃহত্তর বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে মুসলমানদের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent Settlement) প্রবর্তিত হলে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। ডিভাইড এন্ড রুল নীতি অনুসরণ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় ভূমি মালিক বা জমিদার সৃষ্টি করা হয় হিন্দুদের। কৃষকদের অধিকাংশ হয় মুসলমান। যে সামরিক বাহিনী মুসলিম তরুণদের জন্যে ছিল কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস, ক্রমে ক্রমে তা থেকে তারা নির্বাসিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প ক্ষেত্র থেকেও তারা বিতাড়িত হয়। ১৮৩৫ সালে ইংরেজি প্রবর্তিত হয় রাষ্ট্রভাষা ফার্সির পরিবর্তে। গড়ে ওঠে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে ফার্সি ভাষায় দক্ষ মুসলিম শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা পথ হারায়। মুসলিম ব্যবহারবিদরাও অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন। অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন সনাতন চিকিৎসা শাস্ত্রে অভিজ্ঞ হেকিম-চিকিৎসকগণও। নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিন্দু সম্প্রদায় আগ্রহভরে তাদের ছেলেমেয়েদের পাঠালেও মুসলমান সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের জন্য সে পথও বন্ধ হয়। এর কারণ দুটি। এক, ১৭৫৭ এর পর থেকে মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজ বিদ্বেষ প্রকট হয়ে ওঠে। তখনকার সামাজিক ক্ষেত্রে মুসলিম এলিটদের অনীহা এজন্যে কিছুটা দায়ী। দুই, দারিদ্রও এজন্যে প্রধানত দায়ী।

 

তখনকার মুসলমানদের অবস্থা বর্ণনা করে ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার (W. W. Hunter) তার ১৮৭১ সালে লিখিত The Indian Musalmanns 1945: 162) গ্রন্থে লিখেছেন: "একশো বছর পূর্বে এমন কোন মুসলমান পাওয়া সম্ভব ছিল না যে শিক্ষিত ও স্বচ্ছল নয়। এখন এমন একজন মুসলমানও পাওয়া যাবে না যে মুর্খ এবং দরিদ্র নয়।" ['It was impossible to find a Musalman who was not educated and well-to-do one hundred years ago. It is impossible to find a Musalman now who is not illiterate and poor."]।

 

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের (পণ্ডিত নেহেরু সিপাহী বিদ্রোহকে জাতীয় অভ্যুত্থান বলে আখ্যায়িত করেছেন) পরে মুসলমানদের অবস্থা আরো হতাশাব্যঞ্জক হয়ে ওঠে। মুসলিম অভিজাত শ্রেণীকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। বিদ্রোহের সাথে সম্পৃক্ততার অজুহাতে অনেক মুসলিম জমিদার জমিদারি হারান। তাদের সামরিক বাহিনী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। শিল্পপতি ও স্থানীয় বস্ত্রশিল্পীরা সরকারের নীতি ও ব্রিটিশ ফ্যাক্টরির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে পথে বসেন। সরকারি চাকরি থেকে বহু দূরে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়। সেই সময়ের মুসলমানদের করুণ অবস্থা হান্টারের লেখায় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তিনি লেখেন: "একশো বছর আগে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যালয়- অফিস-আদালতে তাদের ছিল একচেটিয়া অধিকার। হিন্দুরা তাদের অতীতের ক্ষমতাধরদের টেবিল থেকে ফেলে দেয়া রুটির টুকরো ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করত" ['A hun- dred years ago, the Musalmans monopolized all the important offices of state. The Hindus accepted with thanks such crumbs as their former conquerors dropped from the table (1945. 161)

 

কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের পরে তাদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ হয়ে পড়ে। ঐ সময়ে মুসলমানদের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে লেখক হান্টার উপসংহারে লেখেন: "মাঝে মাঝে মুসলমানরা তাদের সেই অতীতের তীব্র জাতীয় মনোভাব এবং যুদ্ধবিগ্রহে প্রচণ্ড দক্ষতা প্রদর্শন করলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ব্রিটিশ শাসনে তারা জাতি হিসাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত" ['At intervals Muslims exhibited their old intense feelings of nationality and capability of warlike enterprises but in all other respects they are a race ruined under British rule']। এ সময়ে মুসলমানদের অধঃপতনের কথা বলতে গিয়ে উনিশ, শতকের মধ্যভাগে ব্রাউন (H. C Brown) বলেন, “হিন্দুরা হাইকোর্টের আইনজীবী হিসাবে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন যে, দুইশো চল্লিশ জন দেশীয় আইনজীবীর মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন মুসলমান। ইংরেজি ভাষা ও শিক্ষার প্রতি তাদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ এবং দারিদ্র্য তাদের অধঃপতনের জন্যে অনেকাংশে দায়ী ছিল।

 

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকালে বিগত প্রায় সাতশো বছরের মধ্যে এই দেশে সর্বপ্রথম হিন্দু ও মুসলিমরা এক পংক্তিতে নিজেদের দেখতে পেলেন। শাসন ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত, বঞ্চিত, অবহেলিত ব্যক্তিবর্গ হিসাবে মুসলিমরা এলেন সর্বপ্রথম হিন্দুদের পাশাপাশি। এর পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘকালীন পরিসরে দক্ষিণ এশিয়ায় ছিল মুসলিম রাজত্ব। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় বৃটিশ রাজত্বকালে কাছাকাছি এলে কী হবে, ব্রিটিশ রাজত্ব সম্পর্কে দুই সম্প্রদায়ের চিন্তা ভাবনা এবং অনুভূতি হয় ভিন্ন রকম। মুসলিমরা ব্রিটিশ রাজত্বকে দেখেছেন তাদের দুর্দশার প্রতীক হিসাবে, তাদের দুঃখ-যন্ত্রণা, অধঃপতনের মূল হিসাবে, তাদের দারিদ্রদ্র্য, বঞ্চনার কারণ হিসাবে। কিন্তু হিন্দুদের নিকট ব্রিটিশ রাজত্ব দেখা দেয় এক আশীর্বাদ রূপে। নতুন সম্ভাবনার স্বর্ণালী দ্বারপ্রান্ত রূপে। পলাশীর যুদ্ধে নবীন চন্দ্র সেন লেখেন:

“ভারতেরো নহে আজ অসুখের দিন

আজি হতে যবনেরা হল হতবল”

 

এই কাব্যে নবীনচন্দ্র সেন মুসলিমদের বর্ণনা করেছেন ‘যবন’, ‘স্নেচ্ছ’ হিসাবে, বর্ণনা করেছেন মুসলিম রাজণ্যদের নির্মমতার কথা, বিভিন্ন স্থানে মন্দির ধ্বংসের কল্পকাহিনী, লুণ্ঠন, ধর্ষণের মনগড়া বর্বরতার কথা। সিরাজউদ্দৌলা চিহ্নিত হন রিরংসুক, নির্বিচার, বৈভববিলাসী, নির্বিবেক, নারী নিপীড়ক রূপে। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এক কবিতায় লেখেন:

সমুদয় বিষয়েতে আছি পরিতোষে

কেবল কাঁদিতে হয় গোটাকত দোষে

সেইগুলি গেলে পরে রামরাজ্য হয়

মুক্তমুখে বল সবে ইংরাজের জয়।

এর অবশ্য অন্যদিকও রয়েছে। ১৯০৫ সাল থেকে নবীন সেনদের কালিমালিপ্ত সিরাজের স্থলে জন্মলাভ করেন জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ সিরাজ। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক জনগণের সিরাজ। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী মীর জাফর, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফরা হারিয়ে যায় গণধিক্কারের গভীর গহ্বরে। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তার Discovery of India (1944) গ্রন্থের ২৯৭ পৃষ্ঠায় লেখেন: “এক কালের সমৃদ্ধ ও গতিশীল বাংলায় (পলাশীর যুদ্ধের পরে) গণজীবনে নেমে আসে সীমাহীন দারিদ্র্য, অনাহারের অভিশাপ এবং ব্যাপকভাবে মৃত্যুর পরোয়ানা” [‘Once so rich and flourishing ..... to a miserableness of poverty stricken, starving and dying people’]

 

পণ্ডিত নেহেরুর ব্যাখ্যায় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে সিরাজকে হত্যা করে ক্লাইভ ও হেস্টিংসরা সমৃদ্ধ বাংলায় যে লুটপাটের সূচনা করে- অপহরণ ও লুণ্ঠনের যে উচ্চ মাত্রার সূচনা হয় তারই ফলে ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলা ও বিহারের এক-তৃতীয়াংশ অধিবাসীর জীবনাবসান ঘটে। ঔপনিবেশিকতার ছদ্মাবরণে আধুনিকতাকে যদুনাথ সরকারের মত ঐতিহাসিকরা যে ভাবে আবাহন করেন, জাতীয়তাবাদীরা সে প্রক্রিয়াকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নগ্নরূপ হিসাবে জাতির সামনে তুলে ধরে জাতীয় স্বাধীনতার বাণী প্রচার শুরু করেন। ১৯৪০ সালের জুলাই মাসে বাংলার অন্যতম কৃতী সন্তান সুভাস চন্দ্র বসু সিরাজের কথিত নির্মমতার প্রতীক হিসাবে কুখ্যাত ‘ব্ল‍্যাক হোল’ (Black hole) স্মরণে যে মনুমেন্ট তৈরি হয়েছিল সেই হলওয়েল মনুমেন্ট (Hallwell Monument) ভেঙ্গে ফেলার অভিযানে নেতৃত্ব দান করেন। তিনি কারারুদ্ধ হলে বাংলার আর এক কৃতী সন্তান আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, "বাংলার বিবেক কারারুদ্ধ হয়েছে।" এতো শুধুমাত্র ১৭৫৭ সালের বাংলার কথা নয়। এ হলো বাংলার চিরন্তন ইতিহাস। জাতীয় স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের বা সংকীর্ণ স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে দেশের বাইরের তৃতীয় কোন শক্তির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে দেশকে বিদেশী শক্তির পদতলে টেনে আনার চক্রান্ত এ জাতির ইতিহাসে এক পরিচিত দুর্ঘটনা। বারে বারে ঘটেছে এই দুর্বিপাক। আজও সেই বিষধর সর্পের উদ্যত ফণা দৃশ্যমান।

 

তিন.

উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বাংলায় বড়োসড়ো পরিবর্তনের সূচনা হতে থাকে। ব্রিটিশ শাসকরাও অনুভব করেন যে, বিগত একশো বছরে মুসলমানদের সাথে তাদের আচরণ সঠিক ছিল না। ডব্লিউ হান্টার বৃটিশ রাজের প্রতি মুসলমানদের বৈরীভাবের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “ভারতে আমাদের অনির্বচ্য দুঃখজনক অবস্থানের জন্যে সব সময় মনে হয়েছে যে, সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তিরা আমাদের পাশে নেই।” [‘It has always seemed to me an inexpressibly painful incident of our position in India that the best men are not on our side’]। আর একজন ইংরেজ কান্ট (Wilfrid Scawen Blunt) ১৮৮৩-৮৪ সালে ভারত সফর করে India Under Ripon: A Private Diary শীর্ষক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। সেই গ্রন্থে তিনি মত প্রকাশ করেন যে, ভারতে মুসলিমদের সাথে সুবিচার করা হয়নি। ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে তিনি ভারতসচিব চার্চিলকে (Lord Randolph Churchill) বোঝাতে সক্ষম হন যে “ভারতীয় মুসলিমদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে” (‘Indian Muslims had not been justly treated’)। ১৮৮৮ সালে গভর্নর জেনারেল ডাফরিন (Lord Dufferin) তার বিদায় কালে তাদের প্রতি অবিচারের কথা স্মরণ করে মুসলিম নেতাদের লক্ষ্য করে বলেন: “এককালে ভারতে শাসনকার্য পরিচালনাকারীদের অবস্থানের ব্যক্তিবর্গের উত্তরাধিকার ধারণ করে একথা সুস্পষ্টভাবে অনুধাবনে আপনারা সক্ষম যে, যারা শাসন করেন তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে আপনারা অবহিত (‘Descended as you are from those who formerly occupied such a commanding position in India, you are exceptionally able to understand the responsibility attaching to those who rule’]

 

এদেশের মাটি ভীষণ উর্বর। এ মাটিতে যেমন জন্মে অতি দ্রুতগতিতে আগাছা, তেমনি জন্মে সোনালী ফসল। এই মাটিতে ১৮৭০-১৯০৪ সময়কালে জন্মগ্রহণ করেন একগুচ্ছ উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত কিছু মহাপুরুষ। খাজা সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মত মানুষেরা মুসলমানদের ত্রাতারূপে আবির্ভূত হন মাত্র বছর বিশেকের মধ্যে। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের উদ্যোগ ছিল অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত, হতাশাগ্রস্ত মুসলিমদের মধ্যে নতুনভাবে আশান্বিত করা, তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে নতুনভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা, অন্যায়-অবিচার-অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার করে তোলা। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বড় ব্যাপার, তাই নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী বা ফজলুল হক বা খাজা সলিমুল্লাহর উদ্যোগ ছিল দেশের সর্বত্র ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় তৈরি করা। নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯২২ সালে মন্ত্রী হবার সুযোগ লাভ করেন। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফজলুল হক সাহেবও মন্ত্রী হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি যখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তখনো তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শিক্ষার মাধ্যমে তাদের লক্ষ্য ছিল মুসলিম জনতার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে নিজেদের ভবিষ্যৎ রচনায় উদ্যোগী করে তোলা। এভাবেই তারা চেয়েছিলেন, ১৭৫৭ সালের পরে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় যে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিল সেই অন্ধকার থেকে শিক্ষার মাধ্যমে তারা চেয়েছিলেন আলোর রাজ্যে তাদের ফিরিয়ে আনতে। এই পুণ্যবান মানুষদের ঐকান্তিক আগ্রহে বাংলার কৃষককুলে নতুনভাবে এক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হতে থাকে। দৈনিক আজাদের আকরাম খান, ময়মনসিংহের আবুল মনসুর আহমদ, বরিশালের একে ফজলুল হক, পাবনার মাওলানা ভাসানী এই জাতীয় মানুষ কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসেন। কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষদের মজ্জা অত্যন্ত প্রাণবন্ত। তারা পিছু হটতে জানেন না।

 

আগেই বলেছি, ১৮৩৫ সালে অফিস-আদালতে ফার্সি ভাষার পরিবর্তে প্রবর্তিত হয় ইংরেজি। তখন থেকে দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন হয়। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এই শব্দগুলির প্রচলন হয় তখন থেকে। তার পূর্বে প্রচলিত ছিল মক্তব, মাদ্রাসা, টোল প্রভৃতি শব্দ। ১৮৫৫ সালে কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বাইতে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজির মাধ্যমে লেখাপড়া শেখানো হতো। লক্ষ্য ছিল প্রশাসনের নিম্নস্তরে ইংরেজিতে শাসকদের সাথে ভাবের আদান- প্রদানের সুবিধার জন্যে কিছু সংখ্যক ভারতীয়কে তৈরি করা। এই শিক্ষা সাধারণ শিক্ষা (General Education) নামে পরিচিত। এই শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য সম্পর্কে মেকলে (Macaulay) নিজেই বলেন, “এই মুহূর্তে (ভারতে) এমন এক শ্রেণী সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে যে শ্রেণী আমাদের ও লক্ষ লক্ষ শাসিতের মধ্যে ব্যাখ্যাকারির ভূমিকা পালন করবে। এই শ্রেণী এমন এক শ্রেণী হবে যারা রক্ত ও বর্ণে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, অভিমত, নীতিবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিতে হবে ইংরেজ" [‘We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern, a class of persons, Indian in blood and colour but English in taste, in opinions, in morals and in intellect (H. Woodrow, ed., Macaulay's minutes on education in India wthin the years 1835, 1836 and 1837, Calcut- ta 1862: 115)। এই ধরনের শিক্ষা, বিশেষ করে ইংরেজির মাধ্যমে, মুসলমানদের আকৃষ্ট করেনি। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের সনাতন মক্তব ও মাদ্রাসায় পাঠিয়েছেন। তাছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের পড়াবার সামর্থ্যও তাদের ছিল না। হিন্দু ছাত্রছাত্রীরাই এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছেন।

 

ভারতে সাধারণ শিক্ষা বিস্তৃত হলে, বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিটেনের লিবারাল এডুকেশনের ফলে হিন্দু তরুণ-তরুণীদের প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে চাকুরি লাভ যেমন সহজ হয়, অন্যদিকে তেমনি ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মূলও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। চূড়ান্ত পর্বে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটতে থাকে। ভারতে যুগে যুগে বহুজাতি বিজয়ীর বেশে আগমন করেছে। দীর্ঘকালীন পরিসরে তাদের অনেকেই ভারতে থাকতে থাকতে ভারতীয় বনে গেছে। মুসলমানরা এবং তাদের ধর্ম ইসলাম ব্যতীত প্রায় সকলেই "মহাভারতের এই সাগরতীরে" বিলীন হয়ে গেছে। এমন কী ভারতে উদ্ভূত ও প্রচারিত বৌদ্ধধর্ম পর্যন্ত ভারত থেকে বিতাড়িত হয়েছে। ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এমনি বিচ্ছিন্নতাবাদী। আট শতকের প্রথম দিকে মুসলমানদের ভারতে আগমন এই দিক থেকে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। ভারতে আগমনের পূর্বে মুসলমানরা যেখানেই গিয়েছে সেখানেই তাদের ধর্ম, কৃষ্টি ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই সকল জনপদে। ইরান, তুরস্ক, উত্তর আফ্রিকা, মধ্য এশিয়ার ইতিহাস তাই। কিন্তু ভারতে হিন্দু ধর্মের স্বাতন্ত্র্য ও সুস্পষ্ট আদর্শের ফলে তা ইসলামে বিলীন হয়নি বরং দুই ধর্ম ও দুই সম্প্রদায় সহ-অবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে তেল ও পানির আকারে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাশাপাশি অবস্থান করেছে। এখানকার ইতিহাসের ধারার বৈশিষ্ট্য এমনি। তাই দেখা যায়, অভিজ্ঞ শাসক এই দুই এর সাম্যাবস্থা কোন দিন বিঘ্নিত করতে চাননি। সম্রাট আকবরের সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল তাই।

 

চার.

ভারতে ইংরেজ শাসকদের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ (Divide and Rule) পলিসির প্রভাবে এই সাম্যাবস্থা বিঘ্নিত হতে থাকে। ইংরেজ আমলের প্রথম পঞ্চাশ বছরের মধ্যে মুসলমানরা সম্প্রদায় হিসাবে রূপান্তরিত হয় এক দরিদ্র, অশিক্ষিত এবং কৃষিনির্ভর সম্প্রদায়ে। তখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের জয়গান শুরু হয়েছে। ব্রিটেনে ‘গৌরবময় বিপ্লব’ (Glorious Revolution) প্রায় সমাপ্ত। ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ প্রাণ পেয়েছে। উত্তর আমেরিকা 'জনগণের জয়গানে' মুখরিত হয়েছে। ভারতে কিন্তু নতুন ভাবে সামন্তবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৭৯৩ সাল থেকে। এমনি অবস্থায় ভারতে ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা যে উদ্দেশ্যেই প্রণীত হোক না কেন, পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক শিক্ষার প্রভাবে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু চিন্তাবিদগণের ভাবনা-চিন্তা নতুন পরিবেশে নতুন ভারত গঠনের স্বপ্নে প্রযুক্ত হতে থাকে। নতুনভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন কার্যকর হতে থাকে। নতুন আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল দ্বিবিধ: এক, হিন্দু ধর্মের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে যে সকল কুসংস্কার ছিল তা দূর করা। দুই, হিন্দু জনগণের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি করে তাদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে গড়ে তোলা। এই জাতীয়তাবাদ ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। বাংলায় রাজা রামমোহন রায়, কেদার রায় প্রমুখ মনীষীর প্রচার, ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা, স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাব, বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য কর্ম- উভয় ক্ষেত্রে পানি সিঞ্চন করে। পাঞ্জাবের লালা লাজপত রায় এবং মধ্য ভারতের বালগঙ্গাধর তিলকের অবদান হিন্দু জাতীয়তাবাদের গতিকে প্রাণবন্ত করে তোলে। এই সকল চিন্তাবিদদের অনুভূতি ছিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তারা অনুভব করেছিলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে হিন্দু জাতি সর্বপ্রথম আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ করেছে। এই জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় তারা মুসলমানদের দেখেছেন প্রতিবন্ধক রূপে। তাই ইংরেজ অপেক্ষা মুসলমানরাই ছিলেন তাদের আক্রমণের লক্ষ্য। এই সময়কে তাই চিহ্নিত করা যায় “হিন্দু পুনর্জাগরণের কাল” (Hindu Revival Era) হিসাবে। এ কালের শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)। তিনি বলতেন, “হিন্দুদের ফিরে যেতে হবে বেদের যুগে” (Hindus should go back to the Vedas")। তার মতে, হিন্দুধর্ম পাশ্চাত্যের জড়বাদ বা বস্তুবাদ অপেক্ষা শ্রেয়। চিকাগো শহরে তার বিখ্যাত বক্তৃতার মূলকথা ছিল তাই। ১৮৭৭ সালে দয়ানন্দ স্বরস্বতী (Dayananda Saraswati 1827-1883) আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করে হিন্দুদের মন থেকে অতীতের সকল কুসংস্কার মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন। তার কথায়, বেদে সব কিছুই রয়েছে। যা জানার এবং যা শেখার সব কিছুই বেদে রয়েছে। এমন কী, রেলের কথা, স্টিম এঞ্জিনের কথাও রয়েছে বেদে। তাই বেদ চর্চা করলে সব জ্ঞানের সন্ধান মিলবে। বাঙলার খ্যাতনামা সাহিত্যিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক্ষেত্রের অন্যতম দিকপাল। তার আনন্দমঠের (Abbey of Bliss) দিকে দৃষ্টি দিন, বিশেষ করে আনন্দমঠের অন্যতম চরিত্র দয়ানন্দের দিকে তাকালে অনুধাবনে এতটুকু অসুবিধা হবে না যে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবর্তকরা কী ধরনের মুসলিমবিদ্বেষী ছিলেন। আনন্দমঠের অষ্টম পরিচ্ছেদে এই উপন্যাসের আর এক চরিত্র সত্যানন্দ এবং চিকিৎসকের কথোপকথন দেখুন, সিদ্ধান্ত আপনার।

সত্যঃ মুসলমান রাজ্য ধ্বংস হইয়াছে, কিন্তু হিন্দু রাজ্য স্থাপিত হয় নাই। এখনও কলিকাতায় ইংরেজ প্রবল।

চিকিৎসক: হিন্দুরাজ্য এখন স্থাপিত হইবে না- তুমি থাকিলে এখন অনর্থক নরহত্যা হইবে। অতএব চল।

শুনিয়া সত্যানন্দ তীব্র মর্মপীড়ায় কাতর হইলেন। বলিলেন, “হে প্রভু। যদি হিন্দুরাজ্য স্থাপিত হইবে না, তবে কে রাজা হইবে? আবার কি মুসলমান রাজা হইবে।”

চিকিৎসক: “না এখন ইংরেজ রাজা হইবে।”

মোটকথা, উনিশ শতকে ভারতে যে হিন্দু পুনর্জাগরণের আন্দোলন শুরু হয় তা ছিল প্রধানত মুসলিম বিরোধী আন্দোলন।

কলকাতায় বুদ্ধিবৃত্তিচর্চকারীরা এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তারা নিজেদের “ভদ্রলোক” (Bhadralok) বলে পরিচিত হতে ভালবাসতেন। এদেশে তারাই শুধু ভদ্রলোক। অন্যেরা অর্থাৎ মুসলমান এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুরা সব ‘চাষাভুষা’, অশিক্ষিত, অসচেতন, মাঠের মানুষ। ইংরেজ শাসন ও ইংরেজ শাসকবৃন্দ ছিল তাদের অনুকরণীয়। তাদের নিকট, আগেই বলা হয়েছে, মুসলিমরা ছিলেন জবরদখলকারী, অবৈধ অভিবাসী মাত্র। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বন্দে মাতরম গেয়ে তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করতেন। বিখ্যাত হিন্দু মেলার (Hindu Mela) সূচনা করেন তারা হিন্দু সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের জন্যে। হিন্দু সঙ্গীত, অতীতের সন্যাসীদের অনুসৃত চিকিৎসা পদ্ধতি, পারস্পরিক মিলিত হবার সময় 'নমস্কার' বলা, সাহিত্য চর্চা ক্ষেত্রে সংস্কৃত শব্দের আধিপত্য, মুসলিমদের ভারত বিজয়ের সময় যে সকল হিন্দুযোদ্ধা মুসলমানদের প্রতিরোধে কিছুটা অবদান রেখেছেলেন তাদের 'বীর' আখ্যা দিয়ে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেয়া- এসব বিষয়ে তাদের কর্মকান্ড সীমিত ছিল।

 

পাঁচ.

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবধানটা আরো বৃদ্ধি পায়। ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হয় এবং পূর্ব বাংলা ও আসাম সমন্বয়ে একটি প্রদেশ গঠন করা হয়। নতুন প্রদেশের রাজধানী হয় প্রাচীন শহর ঢাকা। লর্ড কার্জন অনুধাবন করেছিলেন যে, সাত কোটি অধিবাসী অধ্যুষিত বাংলাদেশকে একটি কেন্দ্র থেকে কার্যকরভাবে শাসন করা সম্ভব নয়। প্রশাসকরা এ বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে সজাগ ছিলেন এবং বহু দিন ধরে নথিপত্রে এই ধরনের আলোচনা চলছিল। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের উদ্যোক্তা ছিলেন স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার (Bamfyld Fuller) এবং স্যার এন্ড্রু ফ্রেজার (Andrew Fraser) প্রমুখ প্রশাসকবৃন্দ। তারা বিভিন্নভাবে এই ধারণা দিয়েছেন যে, বঙ্গ ভঙ্গ ছিল নিছক শাসন সংক্রান্ত এক ব্যবস্থা।

১৯২০ সালে লর্ড কার্জন ভারতসচিবকে প্রদেশের সীমানা সংক্রান্ত সম্পর্কে লিখেছিলেন। তাঁর মতে ২০০,০০০ বর্গমাইল এলাকাভুক্ত বিশাল বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর নয়। এই অঞ্চলের জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি সাড়ে আঠার লক্ষ। অন্যদিকে প্রতিবেশী আসাম প্রদেশ ছিল শাসনব্যবস্থার জন্যে নেহায়েত অপ্রতুল। তাই বাংলাদেশকে বিভক্ত করে রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ আসামকে নিয়ে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠন করা হয়। এই প্রদেশের আয়তন হয় ১,০৬,৬৫০ বর্গমাইল এবং এর লোক সংখ্যা হয় তিন কোটি দশ লক্ষ। মোট জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমান ছিল ১ কোটি আশি লক্ষ। হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লক্ষ।

 

প্রশাসনিক কারণ ছাড়াও কয়েকটি রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণও বঙ্গভঙ্গের মূলে ছিল। এক, বিশ শতকের প্রথম থেকে ভারতে জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হলে এই আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। এই আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা। বাংলাকে বিভক্ত করে সরকার চেয়েছিল এই আন্দোলনের গতিধারাকে স্তিমিত করতে। দুই, গত শতাব্দীর শেষ দিক থেকে মুসলমান সামন্তরা মুসলিম স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমদের আলীগড় আন্দোলনের ফলে এবং নবাব আবদুল লতিফের কার্যক্রমে সরকারও মুসলমানদের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিল। বিরাট মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনসাধারণের দাবিও ছিল এই ধরনের একটি পদক্ষেপ। তিন, অর্থনৈতিক কারণও এর একটা প্রধান কারণ ছিল। তখন ভারতের পূর্বাঞ্চলে শিল্প-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল কলকাতা। এখানেই কল-কারখানা গড়ে উঠেছিল। পূর্ববঙ্গ শুধু কাঁচামাল সরবরাহ করত। ফলে পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। বঙ্গভঙ্গ হলে এই অঞ্চলের মুসলমানদের অবস্থা একটু উন্নত হবে। তাই বঙ্গভঙ্গের পদক্ষেপ এই অঞ্চলের অধিবাসীদের নিকট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

 

ছয়.

ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গের একজন আগ্রহী সমর্থক ছিলেন। প্রধানত তিনিই এই বিষয়ে আগ্রহের সাথে কতকগুলি যুক্তি উপস্থাপন করেন। সরকারও তার যুক্তি গ্রহণ করেন বলে জানা যায়। তিনি বলেন: (১) বঙ্গভঙ্গের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে এই প্রদেশের মুসলিম জনসাধারণের সুবিধা হবে প্রচুর। (২) শিল্প প্রতিষ্ঠা ও যাতায়াত ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হবে। (৩) রাজনীতি ক্ষেত্রেও এই অঞ্চলের মুসলমানদের প্রভাব সুদৃঢ় হবে। (৪) এই অঞ্চলের হিন্দু জমিদারদের প্রভাব হ্রাস পাবে। (৫) শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। (৬) এই অঞ্চলের মুসলিমরা তাদের জীবনাদর্শ ভিত্তিক সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ করবে। লর্ড কার্জনও ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন যে, ঢাকা হবে নতুন এক শাসন বিভাগীয় এককের কেন্দ্রবিন্দু। এই প্রদেশে মুসলমানদের বিপুল সংখ্যাধিক্য বিদ্যমান থাকায় এবং তাদের উন্নত ধরনের কৃষ্টির ফলে নতুন প্রদেশে তারা যোগ্য ভূমিকা পালনে সক্ষম হবেন এবং অতীতে মুসলিম শাসনে তাদের মধ্যে যে ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয়েছিল তার পুনর্জন্ম হবে।

 

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। কলকাতার 'হিন্দু ভদ্রলোকরা' ঐ দিনটিকে 'কালা দিবস' হিসাবে পালন করেন এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন, যে কোনভাবে হোক না কেন, বঙ্গভঙ্গ রদ করতেই হবে। বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মতিলাল ঘোষ, আনন্দমোহন বসু, রমেশ চন্দ্র দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল, অশ্বিনী কুমার দত্ত, অম্বিকাচরণ মজুমদার, এ কে মিত্র প্রমুখ কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। যে সব সংগঠন এই আন্দোলন পরিচালনা করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডন সোসাইটি, বন্দেমাতরম সম্প্রদায়, স্বদেশী সমাজ প্রমুখ। এসব সংগঠনে কোন মুসলিম সদস্য কোন সময় ছিল না। হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের প্রধান অভিযোগ ছিল বাঙ্গালিরা একটি স্বতন্ত্র জাতি। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে সরকার এই জাতিকে বিভক্ত করতে চায়। তাই এই পদক্ষেপ ষড়যন্ত্রমূলক, অযৌক্তিক, অন্যায়। এতে মাতৃভূমি কলঙ্কিত হয়েছে। এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রচার অভিযান শুরু হয়। ফলে এর বিরুদ্ধে দুর্বার এক আন্দোলনের সূচনা হয়।

 

বঙ্গভঙ্গের ফলে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তাকে বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বলা কঠিন এজন্যে যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করার মত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মানসিক প্রস্তুতি বা সংহতি বা শিক্ষা কোনটি ছিল না। তাছাড়া, জাতীয়তাবাদের মহিমা কীর্তন করা হয় বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হিন্দু যুদ্ধংদেহী মনোভাব সৃষ্টি করে দেশময় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে মুসলমান ও ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে তা রূপ পরিগ্রহ করে। বাংলা মাতাকে কালীরূপে চিত্রিত করা হয়। “রক্ত পিপাসায় কাতর কালী মাতা। কাপালিক, এলোকেশী, নগ্নদেহী ভয়ঙ্কর কৃষ্ণ মূর্তি, গলায় তার সদ্য ছিন্ন নরমুন্ডের মালা, যা থেকে এখনো রক্ত ঝরছে”। এই হলো বিদেশী পদানত বঙ্গমাতা। ১৯০৮ সালের ৩০ মে কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় এরূপ এক চিত্র অঙ্কিত হয়েছিল।

 

আন্দোলনকারীদের হাতে দ্বিবিধ অস্ত্র ঝিলমিলিয়ে ওঠে। এক, স্বদেশী আন্দোলন ও বিলাতী দ্রব্য বর্জন, এবং দুই, হত্যাকান্ড এবং ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি। বিলাতী পণ্য বর্জনের মাধ্যমে ব্রিটেনের মিল মালিকদের উপর চাপ সৃষ্টির প্রচেষ্টা হয়েছিল যেন তারা ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করে। শত সহস্র মঞ্চ থেকে প্রচার শুরু হয় এবং সমগ্র দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উত্তেজনাপূর্ণ ও অগ্নিগর্ভ সম্পাদকীয় লেখা হতে থাকে। অনেক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। বাংলার গভর্নরকে হত্যার জন্য অন্যূন চারবার প্রচেষ্টা হয়। আহমদাবাদে লর্ড মিন্টোর প্রাণ রক্ষা পায় বটে, কিন্তু ভারতসচিব লর্ড মর্লের রাজনৈতিক সেক্রেটারি লন্ডনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ক্ষুদিরাম বসু এমনি কয়েকটি ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অপরাধে অভিযুক্ত হন এবং শেষ পর্যন্ত তার ফাঁসি হয়। তিনি হন শহীদ ও বরেণ্য। প্রথম থেকেই হিন্দু নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাকে ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্যমূলক উস্কানি বলে আখ্যায়িত করেন। উদারচেতা গোখলেও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করেন। তবে ড. আম্বেকর সমগ্র বিষয়টিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে বিচার করেন। তিনি বলেন। “বাংলার হিন্দুরা তাদের চারণক্ষেত্র রূপে পেয়েছিলেন বাংলা, উড়িষ্যা, এমন কী উত্তর প্রদেশকেও। ঐ সকল প্রদেশে প্রায় সকল রাষ্ট্রীয় কর্মচারী ছিলেন হিন্দু। বঙ্গভঙ্গের ফলে এই অঞ্চলে তাদের “চারণক্ষেত্র সঙ্কুচিত হবার আশঙ্কা দেখা দেয়। বাঙালি হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের অবসান চেয়েছিলেন শুধু এই কারণে।”

 

কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণী, বুদ্ধিজীবী এবং ব্যবসায়ীরা বঙ্গভঙ্গ রদের জন্যে সর্বাপেক্ষা বেশী আগ্রহী ছিলেন। এর কারণ ছিল : এক, বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকার নব জন্মলাভ ঘটবে এবং শিল্প-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসাবে কলকাতার যে গুরুত্ব ছিল তা কিছু পরিমাণ হ্রাস পাবে। দুই, কলকাতা বন্দর দিয়ে যেসব মালপত্র আমদানি-রপ্তানি হতো তার কিছু পরিমাণ চট্টগ্রামে আসতে থাকবে। তিন, কলকাতার ব্যবহারবিদগণও আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, তাদের আইন ব্যবসায়ে মন্দা ভাব নেমে আসবে। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনের ব্যাপকতা ও তীব্রতায় ব্রিটিশ সরকার হতচকিত হয়ে যে বঙ্গভঙ্গকে “প্রতিষ্ঠিত ঘটনা” (A Settled Fact) বলে বার বার উচ্চারণ করেন ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিলি-তে অনুষ্ঠিত বিখ্যাত দিল্লির দরবারে সম্রাটের এক ঘোষণায় তা রদ করা হয়।

 

বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে বাঙালি মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন রকম। স্যার সলিমুল্লাহর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯০৮ সালের ৩০-৩১ ডিসেম্বরে অমৃতসরে মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গ্রহণের সময় বলেন: “নতুন প্রদেশে নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা সরকারের দক্ষতা যেমন বৃদ্ধি করেছে, তেমনি জনগণের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে এবং জনগণের অগ্রগতির পথও সুগম করেছে। ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও মেঘনা অববাহিকা, যা এতদিন ছিল প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন, এখন থেকে জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষাগত ও ব্যবসা ক্ষেত্রে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। পূর্বাঞ্চলের এই প্রদেশে জনগণের জন্য সৃষ্টি করে সম্ভাবনার নতুন বাতায়ন” (“The duplication of the administrative machinery has not only raised the standard of efficiency in the government of the reconstituted province, but has offered a great security of life and property to the people. What was the state of affairs in the eastern part of the province, especially in the tract watered by the Brahmaputra, the Padma and the Meghna? They were detached and segregated from the course of administrative influence that it was impossible under the old system to have hoped for any improvement, social, political, educational or commercial before many long years to come. The partition has given a new life to the people of the eastern province.’

 

সাত.

কলকাতার হিন্দু বুদ্ধিজীবী এবং ব্যবহারবিদগণের বাঙালি জাতীয়তাবাদের সেই যে যুক্তি যা সমগ্র বঙ্গদেশে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল এবং যে আলোড়নের প্রাবল্যে শেষ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছিল তা যে তাদের নিবিড় অনুভূতির ফসল ছিল না তা কিন্তু দেখা গেল মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই, ১৯৪৭ সালে, যখন সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাব কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নয়াদিল্লীতে জনাকীর্ণ এক সাংবাদিক সম্মেলনে স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গ দেশের প্রস্তাব পেশ করেন। আবুল হাশিম ৩০ এপ্রিল এক বিবৃতিতে অখন্ড বঙ্গদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধী বক্তব্য খন্ডন করেন। ১১ মে আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসু গান্ধীজীর সাথে এ বিষয়ে মত বিনিময় করেন। সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুরও এ বিষয়ে গান্ধীর সাথে কথা বলেন। ১৫ মে তারা দিল্লিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথেও কথা বলেন। ৩০ এপ্রিল মুসলিম লীগ সাব-কমিটির সদস্যবৃন্দ এবং প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এবং কিরণ শঙ্কর রায় ও শরৎ বসু কয়েক দফা মিলিত হয়ে স্বাধীন বঙ্গদেশ সম্পর্কে আলোচনা করেন। ১৯৪৭ সালের ২০ মে শরৎ বসুর বাড়ীতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে হিন্দু ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে অবিভক্ত বাংলা (United Bengal) সম্পর্কে একটা বোঝাপড়া হয়। সেই ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্থির হয় যে: এক, বাংলা হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। স্বাধীন বাংলা ভারতের অন্যান্য অংশের সাথে সম্পর্ক নির্ধারণ করবে। স্বাধীন বাংলা হবে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র।

দুই. স্বাধীন বাংলার সংবিধান অনুযায়ী বাংলা আইন পরিষদ সংগঠিত হবে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে এবং যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতিতে নির্বাচিত সদস্য সমন্বয়ে। হিন্দু ও মুসলিম সদস্য সংখ্যা নির্বাচিত হবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে। হিন্দু ও তফসিলী হিন্দুদের আসন সংখ্যাও নির্ধারিত হবে জনসংখ্যা অথবা সর্বসম্মতিক্রমে।

তিন. স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র হিসাবে ব্রিটিশ-রাজ কর্তৃক স্বীকৃত হলে বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে যাবে এবং প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত সমসংখ্যক মুসলমান ও হিন্দু (তফসিলী সম্প্রদায়সহ) মন্ত্রী সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী কালীন সরকার গঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন মুসলমান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন একজন হিন্দু।

চার. নতুন সংবিধান অনুযায়ী আইন পরিষদ এবং মন্ত্রিপরিষদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বিভাগসহ সকল বিভাগে হিন্দু-মুসলমানরা সমান হারে নিয়োগ লাভ করবেন। সকল পদে থাকবেন বাংলার জনগণ।

পাঁচ. সংবিধান রচনার লক্ষ্যে ৩০-সদস্য বিশিষ্ট একটি গণপরিষদ গঠিত হবে। সদস্যদের মধ্যে ১৬ জন হবেন মুসলমান ও ১৪ জন হিন্দু। প্রাদেশিক পরিষদ কর্তৃক তারা নির্বাচিত হবেন।

ছয়. ১৯৪৮ সালের জুন বা তার পূর্বে ব্রিটিশ-রাজ স্বাধীন বাংলা সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ও বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অখন্ড বঙ্গদেশ আন্দোলনের সূচনা করলে কিছু সংখ্যক বাঙালি নেতা এবং সর্বভারতীয় অ-বাঙালি নেতৃত্ব এর বিরোধিতা করেন। হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ১৯৪৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতির মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গের দাবি করেন। ৫ এপ্রিলে তারকেশ্বরে তিনি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা সমন্বয়ে হিন্দু- বাংলা গঠনের দাবি করেন। উক্ত দাবির পক্ষে মত প্রকাশ করে সর্বভারতীয় নেতা আচার্য কৃপালনী বিবৃতি দেন- ১৯৪৭ সালের মার্চে। জওহরলাল নেহেরু, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল বাংলাকে বিভক্ত করার দাবিকে সর্বভারতীয় হিন্দু দাবিতে রূপান্তরিত করেন। ইতিহাসের এক নির্মম পরিহাস, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্যে বাংলার ভেতরে এবং সর্বভারতীয় পর্যায়ে যারা এক অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে সরকারকে বাধ্য করেন, তারাই এবার বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন। বঙ্গীয় হিন্দু-মুসলিম নেতারা বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন বাংলার দূরদর্শী বিচক্ষণ নেতা চিত্তরঞ্জন দাসের সময় থেকে। তিনি বেঙ্গল প্যাক্ট (Bengal Pact) তৈরি করে এগিয়ে আসেন। এবারে বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ ও কিরণচন্দ্র রায় প্রমুখ নেতা এগিয়ে এসে হাত মেলালেন সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম সাহেবের সাথে, কিন্তু তা সফল হয়নি। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, এক্ষেত্রে তার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু মহাত্মা গান্ধী শরৎচন্দ্র বসুর লিখিত পত্রের উত্তরে বলেন, “অখন্ড বঙ্গদেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আপনার ত্যাগ করা উচিত”। অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাবকে একটি কৌশল হিসাবে চিহ্নিত করে ১৯৪৭ সালের ২৩ মে প্যাটেল লিখেছিলেন, “বাংলার অ-মুসলিম জনসমষ্টিকে বাঁচাবার জন্যে বাংলার বিভক্তিকরণ অপরিহার্য” [‘Bengal has got to be partitioned if the non-Muslim population has to survive’]।

 

শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী বাংলার বিভক্তিকরণ চেয়েছিলেন দুটি কারণে এক, “অবিভক্ত বাংলায়”, তার কথায়, ‘নিম্নবর্ণ হিন্দুদের ধর্মান্তকরণের ফলে যেভাবে জনসমষ্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান হয়েছে, তাদের আধিপত্য অসহ্য নয় কী? দুই, বাংলা যদি বিভক্ত হয় তাহলে বিতর্কিত রাষ্ট্র হিসাবে পূর্ব বাংলা দুই বা তিন মাসও তা টিকে থাকবে না।” [If Bengal were partitioned it would not be possible for East Bengal to exist as a hostile state even for two to three months". Star of India 24 May 1947]

 

বঙ্গদেশ শেষ পর্যন্ত বিভক্ত হয়। পূর্ববাংলা পূর্ব পাকিস্তান রূপে টিকে থাকে ২৪ বছর। পাকিস্তানের জলন্ত জঠর থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাণ পেয়েছে বাংলাদেশ রূপে। মুখার্জীর ভবিষ্যৎ বাণীকে মিথ্যা প্রমাণিত করে স্বাধীন বাংলাদেশও টিকে রয়েছে, এবং টিকে থাকবে।

 

এদেশেরও কেউ কেউ দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে কথা বলে নিজেদের অজ্ঞতাকে সুস্পষ্ট করে থাকেন। তারা ইতিহাসের পাঠ গ্রহণ করেননি। সমাজ ব্যবস্থার চালচিত্র সম্পর্কেও তারা সঠিকভাবে অবগত নন। তাদের জানতে হবে বহুজাতির ভারতকে যারা শুধুমাত্র এক জাতির বা শুধুমাত্র হিন্দুদের রাষ্ট্র বলে দাবি করেছেন তারই প্রতিক্রিয়ায় দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানে যখন শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানীদের স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে তখনই পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়েছে। তাদের অনুধাবন করতে হবে যে বাংলাদেশেও রয়েছে বহু জাতিসত্তার মানুষ। বাংলাদেশ শুধুমাত্র বাঙালিদের রাষ্ট্র নয়, যদিও বাংলাদেশে অ-বাঙালিদের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। হলে কী হবে। প্রত্যেক জাতিসত্তার মানুষদের সঠিক মর্যাদা না দিলে ভারতে যা ঘটেছিল, বাংলাদেশ কী সেই অমোঘ প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি পাবে?

 

১৯২৮ সালে ভারতে হিন্দু মহাসভার জন্ম হলে জন্মক্ষণ থেকেই সেই সংগঠনটি প্রচার করতে থাকে যে, “ভারতবর্ষ হিন্দুদের জন্যে। তাদের পিতৃভূমি ও পবিত্র স্থান এটি এবং এটি এমন দেশ, যেখানে শুধু হিন্দুদের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকবে। ভারতে শুধুমাত্র একটি জাতি রয়েছে এবং তা হলো হিন্দু জাতি। মুসলমানরা একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং অখন্ড ভারতে ঐ ভাবেই তাদের অবস্থান চিহ্নিত হবে” [‘All India is Hindustan, the land of the Hindus, at once their fatherland and holy land, and the only land with which Hindus, unlike Moslems are concerned, that there is only one nation in India, the Hindu nation and that the Moslems are only a minority community, and as such must take their place in a single Indian state."- K.K. Aziz, 1979, Delli: 86]

 

১৯৩৬ সালের ২১ অক্টোবর লাহোরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ড. কুরক্রোটি যিনি শঙ্করাচার্য নামে অধিক খ্যাত, সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন: “আমি আবারো ঘোষণা করছি যে, হিন্দুস্থানে জাতীয় কুল, ধর্ম এবং ভাষা হওয়া উচিত হিন্দুদের কুল, ধর্ম এবং ভাষা” [I affirm that in Hindustan the nation as race, religion and language ought to be that of the Hindus"- Ibid: 123]। ১৯৩৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর কানপুরে অনুষ্ঠিত মহাসম্মেলনে সভাপতির ভাষণে সাভারকার (UD Savarkar) বলেন, “যে ভূমি সিন্ধু থেকে দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত তা হলো হিন্দুস্থান। হিন্দুদের নিজস্ব ভূমি। হিন্দুরা যে জাতি গঠন করেছে তারাই এর মালিক। আমাদের নিকট হিন্দুস্থান ও ভারত সমার্থক। আমরা ভারতীয়, কেননা আমরা হিন্দু” [The land which extends from the Indus to the southern sea is Hindustan, the land of the Hindus and we Hindus are the nation that own it. To us Hindus, Hindustan and India mean one and the same thing."]

 

এই অবস্থায় ভিন্ন জাতিসত্তার জনগণের নিকট কী বিকল্প থাকতে পারে? ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হলে অনেকে বলেন, এটা দ্বি-জাতি তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। ঠিক কথা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতি রাষ্ট্র হিসাবে উত্তরণ দ্বি-জাতি তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেছে। কিন্তু সাথে সাথে তা ভারতের এক জাতি তত্ত্বকেও ভুল প্রমাণিত করেছে এবং প্রত্যেক রাষ্ট্রে বহু-জাতি তত্ত্বের সম্ভাবনাকে প্রাণবন্ত করেছে, এমন কী বাংলাদেশেও। এই উপমহাদেশের ইতিহাস তাই বলে। যখন গ্রীক বিজয়ী আলেকজান্ডার ভারতে প্রবেশ করেন বিজয়ীর বেশে তখন এই উপমহাদেশে স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যা ছিল ৬ হাজারেরও বেশি। জাতি ছিল অসংখ্য। তাই ইতিহাসের দিকে তত্ত্ব বা একজাতি তত্ত্বের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে আজকের যে দাবি ছোট ছোট জাতিসত্তার দাবিগুলির প্রতি সহানুভূতির সাথে দেখা উচিত। একালে কোন রাষ্ট্রই প্রকৃতপক্ষে জাতি রাষ্ট্র নয়। সবগুলিই বহুজাতিক রাষ্ট্র। একথা যত দ্রুত অনুধাবন করা যায় ততই মঙ্গল।

 

১৯৪৭ সালে বিশেষ করে বাংলায় যে রাজনীতি ছিল সেই রাজনীতিকে হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতি বলা যায় বটে, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তা ছিল শাসক-শাসিতদের রাজনীতি, তা ছিল সুবিধাভোগী ও সুবিধা-বঞ্চিতদের রাজনীতি। ১৯০ বছরের অবহেলা ও বঞ্চনা ঝেড়ে ফেলে মাথা উঁচু করার রাজনীতি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে, তা দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হোক আর এক-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হোক, এত দিন ধরে মুসলমান জনগণকে যে উৎপীড়ন ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করেছেন তা পরিবর্তিত হবে। আগামী দিনগুলি সুখের দিন হয়ে উঠবে এই প্রত্যাশা নিয়েই তারা মুসলিম লীগের পেছনে সমর্থনের ডালা সাজিয়ে এগিয়ে এলেন। এটি তাদের অনুপ্ররণার মূল কারণ ছিল। কংগ্রেসী নেতাগণ যেমন স্বাধীন ভারতে রাম-রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে হিন্দু জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন, বাঙালি মুসলমানদের সামনে কোন ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল না। তাদের সামনে ছিল মর্যাদাপূর্ণ জীবনের আশা। আর্থিক ক্ষেত্রে একটু স্বচ্ছলতার আকাঙ্ক্ষা, ছেলেমেয়েদের একটু শিক্ষাদান করে আধুনিক মানুষ করার প্রত্যাশা। আগেই বলা হয়েছে, দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে বাংলার মুসলমানরা শিক্ষায়তনের পথ হারিয়ে ফেলেছিল। যে দু’চার জন বিদ্যালয়ে যেত তাদের অবস্থা কেমন ছিল তার বিবরণ দিয়েছেন। কিশোরগঞ্জের জমিদার নীরোদ চৌধুরী তার লেখা The Autobiography of an Unknown Indian গ্রন্থে (Newyork 1951: 232)। তার নিজের কথায়, "হিন্দু ছাত্ররা চেঁচিয়ে বলত যে আমরা মুসলমান ছেলেদের পাশে বসব না কারণ তাদের গা থেকে পিয়াজের গন্ধ আসে। রাজনীতি ক্ষেত্রে সম্প্রদায়গত বিভাজন আসার পূর্বেই শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভাজন সৃষ্টি হয় [‘The Hindu boys had been clamouring that we did not want to sit with the Muslim boys because they smelt of onions... compartmentalisation by communities came into our education before it was introduced into our polities.’]।

 

ইতিহাস জানতে হবে ভালভাবে। বাংলার হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতির কথা বলার পূর্বে দেখতে হবে এই জনপদের মস্ত বড়ো মুসলিম সম্প্রদায় কীভাবে নির্যাতীত হয়েছে। ব্রিটিশ প্রবর্তিত ভূমি ব্যবস্থায় ভূমির মালিক হিন্দু, প্রজারা কিন্তু মুসলমান। চিকিৎসক হিন্দু, রোগীরা কিন্তু মুসলমান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা হিন্দু, কিন্তু ছাত্রদের একাংশ মুসলমান। সমাজে শুধুমাত্র জমিদার কেন, মহাজনি কারবারের মালিকরাও হিন্দু। দেখতে দেখতে যার দু'চার বিঘা জমি ছিল তাও হাতছাড়া হয়ে গেল। ফজলুল হক সাহেবের বড় কাজ অনেক। তার মধ্যে এটিও একটা যে, সাধারণ মানুষগুলিকে তিনি এই মহাজনদের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাই তো তিনি সবার প্রিয় হক সাহেব। একজন তীক্ষ্ণধী রাজনীতিক হিসাবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পর্কে আমার অনেক উঁচু ধারণা এজন্যে যে, গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল ছাড়াও ভারত স্বাধীনতা লাভ করত। হয়ত আরো কয়েক বছর পরে, কিন্তু জিন্নাহ ছাড়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতো না, যেমন শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া বাংলাদেশে স্বাধীনতার সূর্য নাও উঠতে পারত। জিন্নাহর তীক্ষ্ণধী, যুক্তির জোর, পরিস্থিতির যথার্থ অনুধাবন ছিল চমৎকার। তার বিরুদ্ধে যাই কিছু বলুন না কেন, সাম্প্রদায়িকতার দোষে তাকে অভিযুক্ত করা সঠিক নয়। তিনি তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন কংগ্রেসের একজন সদস্য হিসাবে। এক সময় তাঁকে বলা হতো ‘হিন্দু-মুসলিমের মিলনের দূত’। মুসলিম লীগে যোগদান করে তিনি দীর্ঘকাল প্রচেষ্টা চালান যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতের (Federal India) কাঠামোয় মুসলিমদের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ের জন্যে। পরবর্তী পর্যায়ে, তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন যে ভারতে মুসলিমদের জন্যে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র অপরিহার্য কেননা মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র জাতি। এই ঘোষণা আসে ১৯৪০ সালে।

 

জাতি এই ঘোষণারও একটা সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস বিজয়ী হয়ে যে ৬টি প্রদেশে সরকার গঠন করে এত দিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যে কংগ্রেস যে কর্মসূচি গ্রহণ করে তা হিন্দু মহাসভার কর্মসূচির মতই। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত পীরপুর রিপোর্ট এবং ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত শরীফ রিপোর্টের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায় কীভাবে কংগ্রেস সরকার সমূহ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে সরকারি পর্যায়ে হিন্দু রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠান প্রবর্তন করে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিদ্যামন্দির ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে। বন্দেমাতরম গেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুরু, নমস্কার প্রথা চালু, প্রণত হয়ে রাষ্ট্রপিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ছিল ছাত্রছাত্রীদের প্রাত্যহিক কাজ। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত Muslim Sufferings Under Congress Rule পুস্তিকায় আবুল কাসেম ফজলুল হক কংগ্রেস শাসিত প্রদেশসমূহে মুসলিমদের দূরবস্থার চিত্র সবার সামনে তুলে ধরেন। তিনি লেখেন তারা (কংগ্রেস সরকার) সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর তাদের নীতি জোর করে চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। এবং কী তাদের সেই নীতি? গো-মাতাকে সংরক্ষণ করতে হবে, কেননা এদেশ হিন্দুদের দেশ। মুসলমানদের গো-মাংস ভক্ষণ বন্ধ করতে হবে। মুসলিমদের ধর্মকে নিগৃহীত করতে হবে। আজান দেয়া নিষিদ্ধ করতে হবে। মসজিদে মুসল্লিদের আক্রমণ ও নামাজের সময় ও মসজিদের সামনে হৈ-হুল্লোড় করে বিজয় মিছিল পরিচালনা করতে হবে” [‘They set about to impose their will on the Muslim minorities and what was their will? Mother cow must be protected... Muslims must not be allowed to eat beef... the religion of Muslims must be humbled, because was not this the land of the Hindus? Hence the forbidding of Azan, attacks on worshippers in mosque, the insistence on the triumphant passage of noisy processions before the mosques at prayer time'- Ibid: 78]

 

১৯৩৭ সাল পর্যন্ত মুসলিমদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়নি। ১৯৩৭ সালে লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, “ভারতবর্ষে মুসলিম লীগ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়।” (“The Muslim League stands for full national democratic self-government in India”)। কিন্তু পীরপুর রিপোর্ট, শরীফ রিপোর্ট এবং ফজলুল হক রিপোর্টের পরে মুসলিম লীগের চিন্তা- ভাবনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। ১৯৩৯ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, “ক্ষুদ্র দায়িত্ব ও স্বল্প ক্ষমতা প্রয়োগের যে সীমিত ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় স্পষ্টভাবে এটাই প্রমাণিত করেছে যে, হিন্দুস্থান হিন্দুদের জন্যে। কংগ্রেস সরকারের অধীনে মুসলিমরা ন্যায়নীতি বা সততার কোনটিই আশা করতে পারে না” [‘On the very threshold of what little power and responsibility is given, the majority community have clearly shown that Hindustan is for the Hindus. The Muslims can expect neither jus- tice nor fairplay under a Congress Government.’)। তিনি আরো বলেন, “আমি চাই মুসলমানেরা নিজেদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং স্বহস্তে তারা নিজেদের ভাগ্য গড়ে তুলুক। ১৯৪০ সালে লাহোর সম্মেলনে পাকিস্তান প্রস্তাবের মাধ্যমেই তাদের ভাগ্য গড়ে ওঠে। ভারত বিভক্ত হয় এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট।

 

এজন্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ আবার কংগ্রেসকেই দায়ী করেছেন। জওহরলাল নেহেরু তার An Autobiography 1958, London: 158 গ্রন্থে লিখেছেন, “জাতীয় আবরণে অনেক কংগ্রেস নেতা ছিলেন সাম্প্রদায়িক” (Many a Congress man was a communalist under a national cloak)। একই সুরে মুসলিম লীগের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার India Wins Preedom -Calcutta 1959: 15, 177-78, 185 গ্রন্থে লিখেছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঘটনাক্রমের জন্যে জিন্নাহকে পুরোপুরি দায়ী করা সঠিক নয়। সরদার প্যাটেল, যিনি প্রথম থেকেই ছিলেন সাম্প্রদায়িক এবং পরবর্তীকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে মুসলিম লীগের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রবণতা তাকে নি:সন্দেহে এ বিশ্বাসে বিশ্বাসী করে তোলে যে, মুসলিম ও হিন্দুরা দুটো স্বতন্ত্র জাতি এবং ভারত বিভাগ একমাত্র সমাধান। [‘It was Sardar Patel who had been Communal- minded from the beginning and later as result of the obstructive attitude of the Muslim League in the Interim Government became convinced that Muslims and Hindus were sep- arate nations and that partition was the only solution.’]। তিনি আরো লিখেন: কংগ্রেস যদি আরো একটু ধৈর্যশীল এবং দূরদর্শী হতো এবং এ বিষয়ে লর্ড ওয়াভেলের পরামর্শ গ্রাহ্য করত তাহলে পাকিস্তান অবশ্যম্ভাবী নাও হতে পারত। হিন্দু নেতৃবৃন্দের এই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিক্রিয়ায় বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন। এগিয়ে এলেন আবুল কাসেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

 

এদিকে বাংলার রাজনীতির আর একটি দিক এ প্রসঙ্গে তুলে ধরা প্রয়োজন। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলেও ঐ দলটি মুসলমানদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। ১৯০৬ সালে তাই মুসলিম লীগের জন্ম হয় ঢাকায়। অনেক চড়াই-উৎরাই এর পর এই দুটি রাজনৈতিক দল ১৯৪৭ সালে যা ভারতবর্ষে ঘটেছে তার প্রধান নিয়ামক হয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। বৃহত্তর পরিসরে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাথে সাথে ভারতে ১৮৭০-৭৭ সময়কালে ভারতে স্থানীয় পর্যায়ে ইউনিয়ন বোর্ড, লোকাল বোর্ড, জেলা বোর্ড সংগঠিত হলে এই সব সংগঠনের ভূমিকাও রাজনীতি ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে বাংলায়, কেননা উঠতি মধ্যবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এইসব সংগঠন। এসব সংগঠনে যেমন ছিল নির্বাচিত প্রতিনিধি, তেমন ছিল সরকার কর্তৃক মনোনীত সদস্য। জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলকে প্রাণবন্ত এবং গতিশীল করার ক্ষেত্রে এসব সংগঠনের অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত সমগ্র ভারতে যে-নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অবশ্যম্ভাবী (inevitable) হয়ে ওঠে সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবিকে মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়। মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে ১০০টি আসন লাভ করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ করে। প্রাদেশিক আইন পরিষদ সমূহে মুসলিম লীগ ৪৯৫টি আসনের ৪৪৬টি লাভ করে। এসব নির্বাচনে বিরাট বিজয়ের মূলে ছিল স্থানীয় সরকারে মুসলিমদের কার্যকর প্রতিনিধিত্ব। ১৯৩০ সালের পর থেকে বাংলায় স্থানীয় সরকার সমূহে মুসলিমদের বিজয় এবং ফলে হিন্দুদের মধ্যে যে শঙ্কা দেখা দেয় তার বিবরণ রয়েছে Joya Chatterji কর্তৃক লিখিত Bengal Divided: Hindu Communalism and Partition. 1932-1947. New Delhi, 1996 গ্রন্থে। ১৯৩৭-১৯৪৬ সময়কালে বাংলায় পর পর তিন জন প্রধানমন্ত্রী এবং স্থানীয় সরকারগুলিতে মুসলিম আধিপত্য- সবকিছু বাংলায় হিন্দুদের রক্ষণাত্মক এবং অসহিষ্ণু করে তোলে। তাই ভারত বিভাগ তো বটেই, বাংলা বিভাগের জন্যেও তারা মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং বাংলা বিভাগ করে ক্ষান্ত হন।

 

বর্তমান ভারতের সবচেয়ে অগ্রসর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অন্যতম শীর্ষ নেতা যশওয়ান্ত সিং Jaswant singh তার লিখিত Jinnah: India- Partition-Independence, (New Delhi 1909) গ্রন্থে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন ভারত বিভাগের জন্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যতটুকু দায়ী তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি দায়ী গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেলের মত ব্যক্তিবর্গ যারা আজ দেবত্মের আসনে আসীন। তার পূর্বে বিজেপির শীর্ষ নেতা, এককালের রথযাত্রা খ্যাত আদভানী পাকিস্তান সফর করে ভারতে ফিরে এসে বলেছিলেন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাম্প্রদায়িক নন। আদভানীর সেই সত্য উচ্চারণ তার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায় ভারতের সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট সদস্যদের দলের জন্য। তিনি কর্তৃত্বব্যঞ্জক অবস্থান থেকে সেই কথার জন্যে অপসারিত হন।

 

বাংলাদেশে কোনদিন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প বিষাক্ত হয়ে ওঠেনি। এর প্রধান কারণ দুটি এক, মুসলিম জনগণ বরাবর উদারনৈতিক, পরমতসহিষ্ণু এবং সহনশীল। দুই, এই অঞ্চলের মুসলিম নেতৃবৃন্দ, যারা সর্বভারতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারাও ভীষণ অ-সাম্প্রদায়িক। আবুল কাসেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিম উদ্দীন, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাশিম, শেখ মুজিবুর রহমানকে সাম্প্রদায়িকতার ক্লেদ কোন দিন স্পর্শ করেনি। ধর্ম নিরপেক্ষতার অর্থ যদি হয় সম-সাম্প্রদায়িকতা অর্থাৎ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহনশীলতা, তাহলে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বসবাস করছে হাজার বছর ধরে। মুসলমানের কুঁড়েঘর এবং এবং হিন্দুর ছাপড়া হাজার বছর ধরে সখ্য বজায় রেখে দিনাতিপাত করছে। পদ্মা-যমুনা-মেঘনা বিধৌত জনপদে সাম্প্রদায়িকতার আবর্জনা কোন দিন সঞ্চিত হয়নি। আমার অনুভবে সম-সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক চেতনা। ১৯৪৮-৫২ ভাষা আন্দোলনের কালে এই চেতনার ব্যাপক ব্যাপ্তী জাতীয় জীবনে বিরাট অর্জনে সহায়ক হয়ে ওঠে। সহায়ক ভূমিকা পালন করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সংকট কালেও।

 

আট.

বাংলাদেশ একটি অমিত সম্ভাবনার দেশ। এখানকার মাটি বিশ্বের সবচেয়ে উর্বর মাটির একটি। এখানে বছরে তিনটি ফসল ফলে। মাটির নিচে যে সম্পদ রয়েছে তাও অকিঞ্চিতকর নয়। দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপানে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, বাংলাদেশে রয়েছে তার চেয়েও বেশি। হাজারো নদ-নদী, হাওর-বাওর এবং খাল-বিল যদি একটু সযত্ন হাতের স্পর্শ লাভ করে তাহলে এগুলি এক একটা স্বর্ণখনির মত মূল্যবান হতে পারে। মাথার উপরে নির্মল আকাশ, তাও বছরে সাত মাস ব্যাপী, ফলে যথোপযুক্ত প্রযুক্তি সহযোগে অফুন্তর শক্তির উৎস হতে পারে। মাটির উপরে বসবাসকারী বাংলাদেশের জনগণ মানব-উপাদান হিসাবে অতি উত্তম। কিছুটা শিক্ষণ প্রশিক্ষণের স্পর্শে বাংলার বিরাট জনসমষ্টি এক বিশাল মানব সম্পদে পরিণত হতে পারে। সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা-প্রতিহিংসার মত আবর্জনা থেকে তারা অনেকটাই মুক্ত। বর্তমানে দেশে তো বটেই, দেশের বাইরে প্রায় ১৭০টি দেশে এদেশের অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত, বঞ্চিত প্রায় ৭০ লক্ষ তরুণ কাজ করে চলেছেন। তাদেরই উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আন্তর্জাতিক মহামন্দার কালেও বাংলাদেশের তোষাখানা পূর্ণ করেছে। দেশের উল্লেখযোগ্য রপ্তানি খাতের চাকা সচল করে রেখেছে এদেশেরই অর্ধ-শিক্ষিত অবহেলিত প্রায় ২০ লক্ষ তরুণী।

 

দেশের অগ্রগতির জন্যে যা প্রয়োজন তা হলো জাতীয় নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠনের জন্যে এক দৃকশক্তি, এ vision এবং রাজনীতিকসহ নাগরিকদের দেশপ্রেম, Patriotism.

 

লেখক: সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র : A Journal of Politics. March-2011

শম্পাদক শহীদুল ইসলাম