গ্রন্থ পর্যালোচনা : হায়দরাবাদ ট্রাজেডি ও আজকের বাংলাদেশ : আরিফুল হক (প্রেক্ষিত বৃটিশ উপনিবেশবাদের উত্তরসূরী ভারতের কারসাজি)

০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রতিবেশী দেশসমূহের আ্গ্রাসী ষড়যন্ত্র ও আধিপত্য বিস্তারের জাল বিস্তার করাই হচ্ছে ভারতীয় কূটনীতির মূলমন্ত্র। প্রাচীন হিন্দু রাজা এবং শাসকদের প্রখ্যাত রাজনৈতিক উপদেষ্টা কৌটিল্যের কাছে মেকিয়াভেলীয় কূটকৌশলও হার মেনে যায়। এহেন কৌটিল্য কর্তৃক (প্রণীত অর্থশাস্ত্র) হিন্দু রাজা ও শাসকগণকে প্রদত্ত রাজনৈতিক বিষয়ে উপদেশাবলীর কয়েকটি নিম্নরূপ :

 

ক)     ক্ষমতালাভের লোভ এবং অন্যদেশ বিজয়ের আকাঙ্খাকে কখনো মন থেকে মুছে যেতে দেবে না।

খ)      সকল সীমান্তবর্তী রাজ্যকে দুশমন ভাবতে হবে। 

গ)      সারা পৃথিবী চাইলেও তুমি নিজে শান্তির কথা চিন্তা করবে না। তবে বাহ্যিকভাবে শান্তি এবং সৎ প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্কের ভান করে নিজের আসল উদ্দেশ্য আড়াল করার অভিপ্রায়ে তাকে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করা যাবে।

 

                উপরোক্ত রাষ্ট্রদর্শনের বিষময়ফল ভারত স্বাধীনতার ৭৭ বছরে উপমহাদেশের প্রতিবেশীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই আন্তর্জাতিক রীতিনীতি লংঘন পূর্বক স্বাধীন রাজ্য কাশ্মীর, জুনাগড়, মানভাদার ও হায়দারাবাদ জোর করে ভারতের পেটের মধ্যে নিয়েছে। গোয়া, সিকিম সহ আরো কতিপয় রাজ্য ছলেবলে কৌশলে ভারতের পেটের মধ্যে চলে গেছে। মালদ্বীপ, শ্রীলংকা সহ আরো কতিপয় দেশীয় রাজ্য তার চক্রান্তের টার্গেট। ১৯৪৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর উপনিবেশবাদী ভারত বিধ্বংসী অভিযান চালিয়ে স্বাধীন হায়দারাবাদ রাজ্য গ্রাসপূর্বক অন্ধ্র প্রদেশ নামে শাসন ও শোষক পূর্বক ইহার ‍মুসলিম ঐতিহ্য মুছে ফেলেছে। মক্কা মসজিদ, চারমিনার সহ পাঁচশত বছরের মুসলিম শাসনের আভিজাত্যে গর্বিত আওরঙ্গাবাদ, ওসমানাবাদ, নল দূর্গ ইত্যাদি ঐতিহ্যসমৃদ্ধ হায়দারাবাদ আজ সত্যিই নিঝুম গোরস্থানে হারিয়ে যাওয়া এক নিঃস্প্রাণ প্রদীপ। বিশ্বের বিস্ময় জ্যোতির পাহাড় 'কোহিনুর' এর জন্মদাত্রী হিরক আকর, স্বর্ণ, কয়লাখনি সমৃদ্ধ গোলকুন্ডার কন্যা হায়দারাবাদের ঔজ্জ্বল্য উপনেশবাদীদের চক্রান্তে মুছে গেছে, ম্লান হয়েছে এককালের স্বাধীন দেশটি।

 

                দেশবরেন্য নাট্যশিল্পী, চলচিত্র অভিনেতা ও প্রাবন্ধিক আরিফুল হক সাহেবের "হায়দরাবাদ ট্রাজেডি ও আজকের বাংলাদেশ" নামক পুস্তিকাটি পাঠে যে কোন দেশপ্রেমিক মুসলিম ব্যথিত ও আতঙ্কিত হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। বইটি নিছক পড়ার জন্য পড়ার একটি বই নয়, এর ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠতা মুসলমানদের উপলব্ধিকে সমৃদ্ধ ও সচেতন করার উপযোগী হয়েছে। চলমান ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই শোকাবহ সম্প্রসারণ মূলক ঘটনা বর্ণিত বইটি আবেদন রাখবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ছাত্র গণধিকৃত ও ন্যাক্কারজনকভাবে অপসারিত আওয়ামী স্বৈরশাসনোত্তর 'দ্বিতীয় স্বাধীনতা' বলে অভিহিত হরিষে বিষাদ ক্রান্তিলগ্নে আলোচ্য গ্রন্থটি পাঠের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পুস্তক প্রকাশনা সংস্থা বাংলাদেশ কোঅপারেটিভ সোসাইটি লিঃ কর্তৃক সময়ের দাবী মেটাতে ২০০১ সালে উক্ত বইটি প্রকাশনার আঞ্জাম নিয়ে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। ৬০ পৃষ্ঠার এ বইটির মূল্য মাত্র ৫০ টাকা, সূচিপত্র দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত (আলোকচিত্র বাদে)।

 

                ইতিহাস কেবল অতীত নয়, এক কথায় আমাদের ভবিষ্যতও। খনন কার্য্য চালিয়ে বিলুপ্ত ইতিহাসকে উদ্ধার করে যতই স্ব-স্থানে স্থাপন করা যাবে, ততই জাতির আত্মার রূপরেখা বিনির্মাণের কাজটি সহজতর হবে। হায়দারাবাদ হারিয়ে যাওয়া কোন অতীত নয়, মুছে ফেলা কোন দেয়ালের লিখন নয়, ফেলে দেয়া কোন পুরানো ক্যালেন্ডারের পাতা নয়। হায়দারাবাদ আমাদের জন্য জীবন্ত ইস্তেহার, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা, পথচলার মাইলফলক, জাতীয় জীবনের শিক্ষনীয় ইতিহাস। হায়দারাবাদের করুণ পরিণতি আমাদের অনেক কিছু বলতে চায়, অনেক কিছুর প্রতি ইঙ্গিত করে, তাইতো পৌনে একশতাব্দী (১৯৪৮-২০২৪) পরে হায়দারাবাদের ইতিহাস আমাদের সামনে ফিরে ফিরে আসছে।

 

                কবি রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) এই উপমহাদেশের শক, হুন, পাঠান, মোগলকে এক দেহে লীন করতে চেয়েছিলেন। পন্ডিত নেহেরু স্বপ্ন দেখতেন প্রশান্ত মহাসাগর থেকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত সমস্ত এলাকা একদিন ভারতের একচ্ছত্র দখলে চলে আসবে। তখন স্বাধীন রাষ্ট্র স্বত্তা নিয়ে কোন সংখ্যালঘু জাতি টিকে থাকবে না। গান্ধী ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতিকে অভিন্ন বলে চালাতে চেয়েছিলেন। রবার্ট বায়রন তাঁর "দি স্ট্রেটসম্যান অব ইন্ডিয়া" গ্রন্থে লিখেছেন, "বাল গঙ্গাধর তিলক বলেছেন, এই উপমহাদেশের মুসলমান অধিবাসীরা হল বিদেশী দখলদার, কাজেই তাদের শারীরিকভাবেই নির্মুল করতে হবে।" কংগ্রেস সভাপতি আচার্য্য কৃপালিণী বলেছিলেন, "কংগ্রেস অথবা সমগ্র ভারতীয় জাতি কখনই অখন্ড ভারতের দাবী পরিত্যাগ করবে না।" ভারতের প্রথম উপ-প্রধান মন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বলতেন, আজ হোক কাল হোক আমরা আবার এক হব এবং বৃহৎ ভারতের প্রতি আনুগত্য দেখাব। গান্ধী ও অন্যান্য হিন্দু নেতা সম্পর্কে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ”গ্রেট ব্রিটেন ভারত শাসন করতে চায়। মিঃ গান্ধী ও তার কংগ্রেস, মুসলমানদের শাসন করতে চায়। আমরা বলি, ব্রিটিশ অথবা মিঃ গান্ধীকে মুসলমানদের উপর শাসন করতে দেবো না।” চরিত্রগতভাবেই ভারত তার আশেপাশের কোন জাতির অস্তিত্ব স্বীকার করে না। কথিত আছে, এই লক্ষ্যেই ভারত বৃটিশ ভাইসরয় মাউন্ট ব্যাটনকে ভারতের প্রথম গভর্ণর জেনারেল হিসেবে মনোনয়ন দেয়।

 

১৯৪৭ সালের ৫ই এপ্রিল হিন্দু মহাসভার উদ্যোগে তারকেশ্বরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু সম্মেলনে, সর্বভারতীয় হিন্দু নেতা সাভারকর এক বানীতে বলেছিলেন, "প্রথমতঃ পশ্চিমবঙ্গে একটা হিন্দু প্রদেশ গঠন করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ যে কোন মূল্যে আসাম থেকে মুসলিম (অনধিকার প্রবেশকারী) বিতাড়ণ করে, এ দুটি হিন্দু প্রদেশের মাঝে ফেলে পূর্ব পাকিস্তানকে পিষে মারতে হবে।" সেই হিন্দু মহাসভার অঙ্গদল বিজেপি এখন ভারতের ক্ষমতার শিখরে। তারা ১৯৪৭ সালে মুসলিম প্রধান বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করে হিন্দু পশ্চিমবঙ্গ গঠন করেছে। ১৯৪৭ থেকে ৮৫ এর মধ্যে আসাম থেকে মুসলমান বিতাড়ণ প্রক্রিয়াও শেষ করেছে। পূর্ব পাকিস্তান নামটিও মুছে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এখন পিষে ফেলতে বাকি রয়ে গেছে বাংলাদেশ। তারই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। এই সময় হায়দারাবাদের দৃষ্টান্ত আমাদের সতর্ক হওয়ার সুযোগ করে দেবে বলে বিশ্বাস করি। মাঝে মধ্যে বাংলাদেশকে ভারতের মানচিত্রে প্রদেশ হিসাবে দেখানো ও তার শীর্ষ শাসনকর্তাকে মুখ্যমন্ত্রী বলা যে ঐ আধিপত্যবাদেরই প্রতিফলন তা বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখে না।

 

                হায়দারাবাদের জনসংখ্যার ৮৮.৬ ভাগ হিন্দু এবং ১০.৪ ভাগ মুসলমান ছিল, ফলে হায়দারাবাদের হিন্দু ভারতের আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেনি। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৮৮.৫ ভাগ মুসলমান এবং অবশিষ্ট ১১.৫ ভাগ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান জনগোষ্ঠী। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিণতি হায়দারাবাদের মত হবে না বলে যারা মনে করেন, তাদের হয়তো জানা নেই যে, ৮৮.৫ ভাগ মুসলমানদের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকেও যদি বৈদান্তিক মস্তিষ্ক এবং ইসলামী দেহধারী মানবগোষ্ঠী অর্থাৎ শুধু মুসলমান নামধারী জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করা যায়, তাহলে তো উদ্দেশ্য সাধনে অসফল হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না। বাংলাদেশে সেই প্রক্রিয়াই শুরু করা হয়েছে।

 

                ইতিহাসের ধারাক্রম লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, এদেশের মুসলমানেরা দীর্ঘ ২১৪ বছর ধরে স্বাধীনতার যে লড়াই করে এসেছে সেই লড়াই এর সবটুকু ছিল তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই। ভারতের বহু ঈশ্বরবাদ, সামাজিক বৈষম্য, ব্রাহ্মণদের জন্য একমুখী ন্যায় ও কল্যাণের দর্শনের সঙ্গে মুসলমানদের একেশ্বরবাদ, সাম্য সামাজিক সুবিচার, ন্যায় ও কল্যাণ বোধের জীবন ব্যবস্থার মিল ছিল না বলেই পাকিস্তান সৃষ্টির প্রয়েোজন হয়েছিল। হিন্দু আর্য সভ্যতার সামাজিক ভিত্তি ছিল বংশানুক্রমিক বর্ণ বৈষম্য, গোব্রাহ্মণে বিশেষ ভক্তি এবং মুসলিম সভ্যতার ভিত্তি হলো সাম্য এবং মানব সমতা। অন্যান্য জাতি ও সম্প্রদায়ের সাথে মুসলমানদের সামাজিক সাংস্কৃতিক অনেক পার্থক্য। এই পার্থক্য রক্তের, মানমানসের, ধর্ম-কর্মের, নাম-নিশানার, এবাদত-বন্দেগীর, খাদ্য-খাবারের, পোষাক-পরিচ্ছদের, আইন-কানুনের, জীবনবোধের, জীবন-যাপনের এবং জীবন সাধনার। এ পার্থক্য হাজার বছর আগেও যেমন ছিল আজও তেমনি আছে। এই পার্থক্যের কারণেই মুসলমানেরা হিন্দু ভারতে টিকে থাকতে পারেনি, স্বতন্ত্র আবাসভূমি গড়তে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক, বর্তমান প্রজন্ম সে ইতিহাস সম্পর্কে জানে না। জানতে চেষ্টাও করে না। সুযোগ ও সীমিত না হয় বিকৃত।

 

                তাই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর পাকিস্তান বিরোধকে ইসলাম বিরোধী হিসেবে প্রচার করা হল। পাকিস্তানের ২৪ বছরই শুধু নয়, মুসলিম আমলের কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসকে শোষণের ইতিহাস বলে অগ্রাহ্য করা হল। বুদ্ধিজীবিরা বোঝাতে লাগলেন যে, মুসলিম ইতিহাসের সাথে সম্পর্ক রক্ষা হবে আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। নিজেরা তুর্কী বা ফারসী ভাষাভাষী হয়ে যারা পরিত্যক্ত বাংলা ভাষাকে জাতে তুলেছিলেন, বর্গী, মগ, মারাঠাদের অত্যাচার থেকে যারা দেশকে বাচিয়েছিলেন, ইতিহাসের সেই বীর পুরুষেরা হয়ে গেলেন উৎপীড়ক, আরা যারা কলকাতায় বসে এদেশের উৎপাদিত ফসলের পয়সায়, এদেশের খেটে খাওয়া মানুষের ঘামের দামে কলকাতার শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন, যারা বর্গী হয়ে, মাড়োয়ারী হয়ে, জমিদার হয়ে, যুগ যুগ ধরে এদেশের মুসলমানদের শোষন করলেন, নির্যাতন করলেন, রাতারাতি তারাই হয়ে গেলেন আপনজন। এসব ঘটনা কি ইতিহাসের কোন অমোঘ সত্যের দিকে নির্দেশ করে না? বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মানুষকে সেই সত্য ভুলিয়ে দেয়া হল যে, ৪৭ এর স্বাধীনতা হয়েছিল বলেই ৫৫ হাজার বর্গমাইল এলাকার, অবহেলিত উপেক্ষিত ৪ কোটি নাঙ্গাভুখা মানুষ স্বাধীন জাতির গৌরব অর্জন করতে পেরেছিল। নির্জীব, পতিত জেলা শহর ঢাকা, ২০০ বছর পর আবার রাজধানীর সাজে ঝলমল করে উঠেছিল। দেশে সৃষ্টি হয়েছিল কলকারখানা, ব্যাংক, বীমা ঢাকাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গণেও মুসলমান ছেলেমেয়েদের অবাধ দৃপ্ত পদচারণা শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ বাঙালী মুসলমানদের আজ যেটুকু অর্জন তার সিংহভাগেই ছিল ৪৭ এর স্বাধীনতার দান। সে কথা ভুলিয়ে দিয়ে রটনা করা হল ৪৭ এর স্বাধীনতা ভুল ছিল।

 

কিছুদিন আগে কলকাতার মওলানা আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ এর উদ্যোগে তিনদিন ব্যাপী এক আলোচনা চক্র অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল দেশভাগের ৫০ বছর পর এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর কি করা উচিত। সেখানে বাংলাদেশের মুখচেনা কিছু বুদ্ধিজীবী (যাদের জাতিগত পরিচয় মুসলমান) বলেছিলেন, উপমহাদেশের মানচিত্রে কোন রকম রদবদল না ঘটিয়ে দেশ বিভাগের আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ আবার সেই শক, হুন, পাঠান, মোগল এক দেহে লীন করার প্রস্তাব। আর এবার প্রস্তাব রেখেছেন কোন ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক নয়, স্বয়ং বাঙ্গালী মুসলমানের সন্তান, যারা ৪৭ এর স্বাধীনতার সুফল ভোগ করেছেন সবচেয়ে বেশী। এরপরও কি বিশ্বাস করার অবকাশ আছে যে, এদেশের সংখ্যাগুরু মানুষ আদমশুমারীর বদৌলতে মুসলমান হওয়ায়, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত থাকবে?

 

                ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্ট ব্যাটেনের প্ল্যান যখন ঘোষিত হয়, তখন একজন ব্রিটিশ সিভিলিয়ান টাইসন পূর্ববঙ্গকে বলেছিলেন, ‘রুরাল স্ল্যাম’। ব্রিটিশ শাসন থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সেই রুরাল স্ল্যামই পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছিল। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এদেশে শিল্পখাতে সর্বসাকুল্যে বস্ত্রকল ৫টি, ৪টি চিনিকল ও ১টি সিমেন্টের কারখানা ছিল। পাট উৎপাদনকারী অঞ্চল বলে খ্যাতি থাকলেও একটাও পাটকল ছিল না। ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর ৭১ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে সেই রুরাল স্ল্যামের বুকেই পাটকল স্থাপিত হয়েছিল ৭৬টি, বস্ত্রকল স্থাপিত হয়েছিল ৫৯টি, চিনিকল ১৫টি। এছাড়াও বহু ইস্পাত কারখানা, রিফাইনারী, রাসায়নিক কারখানা, কাগজ কল, ঔষধের কারখানা, চামড়া ও জুতার ফ্যাক্টরী, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরী, অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরী, বিমান বন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, টিভি স্টেশন, রেডিও স্টেশন নির্মিত হয়েছিল।

রুর‌্যাল স্ল্যাম থেকে উন্নয়নের এই ধারা বিশেষজ্ঞদের মতে সন্তোষজনক বলেই বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু আধিপত্যবাদীদের স্বদেশী দোসররা এই উন্নয়নের বিকৃত ব্যাখ্যা করে জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হলো যে, পশ্চিম পাকিস্তান পুজিপতিরা এদেশে শুধু শোষন করেছে। বুঝতে দিল না জনগণকে যে, দেশভাগ হওয়ার সময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল এক গন্ডগ্রাম। যেখানে ছিল না কোন সমৃদ্ধ কলকারখানা। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল তখন চার চারটি রাজধানী শহর, লাহোর, করাচী, পেশোয়ার ও কোয়েটা। এই সমুদয় এলাকা বিশেষ করে পাঞ্জাব ছিল শিল্প-কারখানা, কৃষি, শিক্ষা-দীক্ষা এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ভরপুর। ফলে দুই পাকিস্তানের এক হয়ে থাকা সম্ভব হলো না, শক্তিশালী পাকিস্তান ভেঙ্গে দু-টুকরো হয়ে গেল। যার ফলে লাভ হলো তাদের যারা পূর্ব পাকিস্তানকে পিষে মারতে চেয়েছিল। আর বেরুবাড়ী তালপট্টি দখল, উজানের পানির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বাংলাদেশকে আবার ল্যান্ড অব বেগার বা ভিক্ষুকের জাতে পরিণত করা, পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এসবই সেই উদ্দেশ্যের পরিণতি।

 

                আজ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা বলে এপার বাংলা ওপার বাংলার ধুয়া তুলে ধরা হচ্ছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাই যদি আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি হত, তবে পশ্চিমবঙ্গ তো ভারতের অংশ হওয়ার কথা নয়। ১৯০৬ থেকে ১৯১১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত যারা পূর্ব বাংলা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশকে অখন্ড ভারতের একটা প্রদেশের মর্যাদা নিয়েও টিকে থাকতে দেয়নি, বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ রোধ করার জন্য সশস্ত্র প্রতিবাদ আন্দোলন করছে, ১৯৪৭ সালে তারাই কেন আমাদের সাথে স্বাধীন বাংলায় থাকার চাইতে, বাঙালীত্ব বিসর্জন দিয়ে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাথে বিলীন হয়ে গেল। বাংলা ভাষাভাষী ভাইয়েরা খোট্টা হিন্দিভাষী ভারতীয়দের সাথে একাত্ম হওয়াটাকে শ্রেয় মনে করলো কেন? গূঢ় উদ্দেশ্য নিয়ে সে কথা আজ আবেগ শূণ্য মন নিয়ে ভেবে দেখতে হবে।

 

                ৭১ এর পর মুসলমান নামধারী কোন কোন বুদ্ধিজীবী উচ্চকন্ঠে প্রচার করছেন ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল বলেই নাকি পাকিস্তান টেকেনি। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, ভারত টিকে আছে কিসের ভিত্তিতে? উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ এবং রাজপুতদের সাথে পশ্চিম ভারতের মারাঠাদের পোষাক-পরিচ্ছদ, ঐতিহ্য সংস্কৃতির তো কোন মিল নেই। তারপরও তারা একসাথে টিকে আছে কি করে? দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়দের সাথে পশ্চিম বঙ্গের মছলীখোর বাঙালী একই রাষ্ট্রকাঠামোর আওতায় বাস করছে কি করে? তাদের মধ্যে একমাত্র ধর্মীয় বন্ধন হিন্দু হওয়া ছাড়া তো আচার-ব্যবহার, পোষাক, খাদ্য, সংস্কৃতি, ভাষা কোন কিছুরই মিল নেই। আসলে ওসব কিছু নয়। প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান এবং পরে বাংলাদেশ নামক যে কাঁটাটি তাদের গলায় আটকে আছে, তাকে উৎপাটন করার জন্যই এসব ছলনার অবতারণা। পাটের সাথে যেমন আগাছা জন্মায়, মুসলমানদের মধ্যেও তেমনি মীরজাফর, মীর সাদিক, আল ইদরুস যুগে যুগে জন্ম নিয়েছে। বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগুরুর দেশ হলেও তার স্বাধীনতা শংকামুক্ত নয়। কারণ যে দেশের মানুষ টাকার অংকে দেশপ্রেম বিক্রি করে, অন্যের প্ররোচনায় আপন পরিচয় মুছে ফেলে ইতিহাসের ঐতিহ্যের মুখে কালিমা লেপন করে, উদারতার ছদ্মবেশে আত্মপরিচয় ধুলায় মিশিয়ে দেয়, টাকার লোভে কিংবা সামান্য পদ পদকের লোভে দেশের মান মর্যাদা, গোপন দলিল এমন কি দেশের মাটি ও সম্পদের অংশ আধিপত্যবাদীদের হাতে তুলে দেয়, যে দেশের মানুষ নিজের মাটি মানুষের সাথে সদা বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত থাকাকে গৌরব মনে করে, সে দেশের মুসলমান জনসংখ্যা ৮৮.৫ ভাগ হলেও তারা হায়দারাবাদের ১০.৪ ভাগ মুসলমানের সমান শক্তিশালীও নয়।

 

                কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী আবার ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে বড়াই করে বলেন, ভাষা আন্দোলনই না কি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা পর্ব। সেখানেও কথা থেকে যায়। ১৮টি আঞ্চলিক জাতিসত্ত্বার এবং ১০৫টি ভাষা-উপভাষার দেশ হয়েও হিন্দু প্রধান ভারতে বিহারী, বাঙালী, গুর্খা, মারাঠী, তামিল, গুজরাটি, রাজপুত সবাই এক ভারতীয় হিন্দু জাতিসত্ত্বার পরিচয়ে টিকে থাকলো, অথচ মাত্র ৬টি আঞ্চলিক জাতিসত্ত্বা যেমন - বাঙালী, সিন্ধী, কাশ্মিরী, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্থান নিয়ে গঠিত এবং বাংলা, পাঞ্জাবি, সিন্ধী, বালুচি, বারুহী, পশতু, কাশ্মিরী, ৭টি ভিন্ন ভাষার দেশ হয়ে পাকিস্তান মুসলমানদের জাতিসত্ত্বার পরিচয়ে এক হয়ে টিকে থাকতে পারলো না কেন? আবেগ বিবর্জিত মানুষের মনে এ প্রশ্ন আসে বৈকি? আর তখনই মনে হয় হায়দারাবাদের শিক্ষা আমাদের বড় প্রয়োজন। এসব প্রশ্নের উত্তর যদি বইটিতে পাওয়া যায় লেখা ও অধ্যয়ন স্বার্থক হবে। সর্বোপরি, অধুনা ইসলাম ও মানবতা বিরোধী মিডিয়ার অপপ্রচার থেকে মুক্ত থেকে আবেগের গাঢ় প্রলেপ মুছে ফেলে ইতিহাসের সত্যালোকে উদ্ভাসিত হতে বইটি পাঠককে সাহায্য করবে বলেই অশিতিপর বৃদ্ধ প্রবন্ধকার, আসন্ন মৃত্যুর পূর্বক্ষণে দেশ-প্রেমিক চিন্তাশীল নাগরিকের পথ-নির্দেশক মাসিক ইতিহাস অণ্বেষার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতার অতন্ত্র প্রহরী, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র গণ আন্দোলনের হোতা ও প্রকৃত দেশপ্রেমিক দেশবাসীকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশবাসীর আশু দৃষ্টি আকর্ষন করা হল।

 

নোট : মাসিক ইতিহাস অন্বেষার পরবর্তী সংখ্যায় আলোচ্য গ্রন্থের কিংবদন্তী লেখক নিবেদিত 'আজকের বাংলাদেশ' শীর্ষক উপসংহার মূলক অধ্যায়টি প্রণয়নের প্রয়াস নেয়া হবে। ইনশাআল্লাহ। গ্রন্থ পর্যালোচনার স্বাভাবিক পদ্ধতি এখানে বিশেষ কারণবশতঃ পালন করা হয়নি বিধায় প্রবন্ধকার দুঃখিত।

 

 

প্রফেসর মোঃ মোসলেমউদ্দীন শিকদার

সালেহা মঞ্জিল, দঃ বিজয়পুর

গৌরনদী,বরিশাল।

                                                                     মোবাইল : 01712233200