সূচনা (পর্ব-১)
ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর
বা ঢাকা (শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয়রা যে নামে ডাকত) সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী
হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এটি একটি প্রাচীন শহর যার অপরিমেয় মনোমুগ্ধকর ঐতিহাসিক
পটভূমি রয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে
এর নতুন ভূমিকা অনেকের নজর কেড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে, ত্রয়োদশ শতাব্দী
থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই শহরটি যেসব উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে তার
বিবরণ, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য যথেষ্ট আগ্রহের বিষয় হতে পারে।
মুসলমানদের
বঙ্গ অভিযানের আগের দীর্ঘ বছর ধরে পূর্ব বাংলা পৃথক পৃথক রাজ্যে বিভক্ত ছিল যা বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ
রাজাদের বিভিন্ন রাজবংশ দ্বারা শাসিত ছিল। পূর্ব বাংলা তখন সমতট বা বঙ্গ নামে পরিচিত
ছিল, যেখানে উত্তর-বাংলা পুন্ড্র বা সাধারণত গৌড়-পান্ডুয়া নামে পরিচিত ছিল।
ইন্দো-পাকিস্তান
উপমহাদেশের অন্যান্য শহর ও প্রদেশের ভাগ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, বাংলাও তার রাজধানী
পরিবর্তনের কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। অতএব, যদি এই বিবরণের ক্ষেত্রটি বিস্তৃত
করে বিভিন্ন শহরের উত্থান-পতনের অসামঞ্জস্য ইতিহাসকে পাখির চোখে দেখানোর মত করে চেষ্টা
করা হয়, তা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। প্রকৃতপক্ষে, বিভিন্ন ঘটনাগুলি সমন্বিত প্যাটার্নের
টেক্সচারে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে এগুলো উপস্থাপনার জন্য কিছুটা বিস্তারিত সমীক্ষা
চিত্রের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়।
বখতিয়ার
খলজি
তুর্কি, পাঠান
ও মোগলরা প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাব্দী (১২০৩-১৭৫৭) ধরে বাংলাকে শাসন করেছে, এটার (বাংলার)
প্রথম অভিযানকারী ছিলেন ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি, যিনি ১২০৪ সালে,
নবদ্বীপ (ফারসি ইতিহাসে নওদেহ বা নতুন গ্রাম নামে উল্লেখ করা হয়েছে) বিজয় করেন, এটি
তখন বাংলার রাজধানী ছিল। তার অভিযান (এর বর্ণনা) গুলিতে মুসলমানদের দুঃসাহসিকতা এবং
একত্ববাদের প্রতি অবিশ্বাসীদের নাজুক মানসিকতার সব বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান ছিল।
রাজা লক্ষ্মণ
সেন (তখন প্রায় ৮০ বছর বয়সী ছিলেন) নবদ্বীপের শাসক ছিলেন
(১)। ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে, তার রাজকীয় জ্যোতিষীরা বিদেশী “ম্লেচ্ছ“ (২) এর হাতে
তাঁর পতনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। একদিন, যখন রাজা তার দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন, তখন
হঠাৎ "আল্লাহু আকবার" এর ভয়ঙ্কর শব্দ তার দরজায় শুনলেন। সাথে সাথেই তিনি
নার্ভাস হয়ে, নিজের হাত না ধুয়ে, নিজের পরিবারকে ত্যাগ করে প্রাসাদের পেছনের দরজা
দিয়ে পালিয়ে গেলেন। অতঃপর লক্ষ্মণ সেন ঢাকার বিক্রমপুরে ফিরে আসেন যেখানে তার সেন
রাজবংশ বেশ কিছু বছর ধরে শাসন করেছিল। উক্ত সময়ে বখতিয়ার (৩) নবদ্বীপ শহরে ঘোড়া ব্যবসায়ী
হিসাবে প্রবেশ করেন এবং মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহীর দল নিয়ে অভিযান শুরু করেন। তখন লক্ষ্মণাবতীতে
(লুকনোটি) রাজার জন্য একটি নতুন দুর্গ তৈরি করা হচ্ছিল, যেখানে তিনি শীঘ্রই স্থানান্তরিত
হওয়ার কথা ছিল। বখতিয়ার দূর্গে প্রবেশ করেন, খুৎবা পাঠ করেন এবং মোহাম্মদ বিন সাম
ওরফে সুলতান শাহাবুদ্দিন মাহমুদ ঘোরীর নামে মুদ্রা মুদ্রণ করেন (যা ছিল আধিপত্যের প্রতীক)।
এরপর তিনি তিব্বত জয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন; কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই অভিযান ব্যর্থ
প্রমাণিত হয় (৪)। বখতিয়ারের অননুমোদিত বঙ্গ ও বিহার বিজয় পরে দিল্লির সুলতান কুতুবুদ্দিন
আইবেক দ্বারা স্বীকৃত হয়। বাংলায় তার সদর দফতর ছিল দিনাজপুর জেলার দেওকোটে (৫)।
পাদটিকাঃ
১. কিছু লোক
ঐতিহাসিক নবদ্বীপকে বর্তমান নদিয়া জেলার সদর দফতরের সাথে সংযুক্ত করে। সাম্প্রতিক
তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে যে ঐতিহাসিক নবদ্বীপ রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ থানার রোহানপুরে
অবস্থিত। বলা হয়ে থাকে যে এর ধ্বংসাবশেষ একটি উল্লেখযোগ্য দৈর্ঘ্যের স্তূপ দ্বারা
আচ্ছাদিত। স্থানীয়ভাবে এ জায়গাটিকে নওদাহ নামে ডাকা হয়, যা সম্ভবত এখন পাকিস্তানে
(পূর্ব-পাকিস্তান) পড়ে।
২. 'ম্লেচ্ছ'
শব্দটি ঘৃণার অর্থে ব্যবহার করা হয়। আমরা এখনও আমাদের কথ্য ভাষায় [অশুদ্ধ] বলে মাংসাশী
অভ্যাসের লোকদের বোঝাতে ব্যবহার করি। উল্লেখযোগ্য যে হিন্দু পুরাণে মুসলমানদেরও জবানা
(Yonan বা yona শব্দ থেকে আগত যার অর্থ গ্রিক) বলা হয়েছে। সংস্কৃত ভাষায় এটি তাদের
বোঝায় যারা দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায় এবং এটা তুর্কি অভিযাত্রীদের প্রতি প্রয়োগ করা
হয়েছিল, যারা তাদের দ্রুতগতির অশ্বারোহী ইউনিটগুলির জন্য পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব
প্রথম বা দ্বিতীয় শতাব্দীতে এই শব্দটি গ্রিকদের জন্য প্রয়োগ করা হতো। পরে যখন এটি
মুসলমানদের জন্য প্রয়োগ করা শুরু হয়, তখন থেকে এটি ঘৃণার অর্থে ব্যবহার করা হয়।
৩. বখতিয়ার
মাত্র ২০০ জন ভ্রাম্যমান অশ্বারোহী নিয়ে বিহার জয় করেছিলেন। তিনি প্রায় ১২০৫ সাল
পর্যন্ত বাংলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিয়ার-ই-লুকনোটি শাসন করেছিলেন।
৪. এই পশ্চাদপসরণ
তার স্বাস্থ্য এবং মনোবলকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। তিনি ১২০৫ সালে মৃত্যুবরণ
করেন এবং দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুরের নিকটবর্তী দেওকোটে তাকে সমাহিত করা হয়। বলা
হয়ে থাকে যে বখতিয়ার রংপুর শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
৫. দেওতলা
বা দেওকোট পরবর্তীতে তবরেজাবাদ নামে পরিচিত হয়েছিল, শেখ জালালুদ্দিন তবরেজীর নামে
যার তকিয়াগাহ (আশ্রয়স্থল) দেওতলাতেও ছিল।
The Hellish Paradise (নারকীয় স্বর্গ)
পর্যবেক্ষণ
করলে দেখা যায় যে, ভারতে মুসলিম শাসনের অন্যতম প্রাচীন উপনিবেশ ছিল বাংলা। পরবর্তীতে
প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে দিল্লির সুলতানরা তাদের গভর্নরদের মাধ্যমে বাংলা
শাসন করেন। সোনারগাঁয়ের সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ এর সময় (১৩৩৮) থেকে আকবরের সময় পর্যন্ত, বাংলা হয় দিল্লির নামমাত্র
আধিপত্য মেনে নিয়েছিল অথবা তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা বজায় রেখেছিল। এর কারণ হল দিল্লির
সুলতানরা প্রায়শই বাংলার বড় ও উত্তাল নদী, অসংখ্য ছোট নদী ও বিল পেরিয়ে যাওয়ার
সম্ভাবনায় সন্ত্রস্ত বোধ করতেন যা বাইরের আক্রমণকারীদের জন্য প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে
কাজ করে। এছাড়া, বাংলার
বিশাল ভূমি, যা বর্ষাকালে সম্পূর্ণভাবে পানিতে তলিয়ে যেতো এবং ফারসি ইতিহাসে যা 'বেরশাকাল'
(সংস্কৃত- বর্ষাকাল) নামে পরিচিত ছিল, এই সময়টা (বর্ষাকাল) পশ্চিমের শুষ্ক ও নির্জীব
ভূমি থেকে আগত সাহসী অভিযাত্রীদের উৎসাহকে সবসময়ই নিস্তেজ করে দিত। তাদের রাজা ও সেনাপতিদের কাছে বাংলা ''নারকীয় স্বর্গ'' (Dozakh Bar Jannat-دوزخ بر جنت) নামে পরিচিত ছিল, তারা শুষ্ক মৌসুমে
বিশাল অভিযানকারী বাহিনী নিয়ে বাংলায় আসতেন; কিন্তু 'বেরশাকালের' প্রতিকূল পরিস্থিতি
উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথেই তারা প্রায় ছয় মাসের জন্য তাদের বাহিনীকে সেখানে বন্দী
করে রাখতেন এবং বাংলার মনোমুগ্ধকর পরিবেশে নিজেদের ঢেকে রাখতেন। তারপর তাদের কেউ কেউ
বাংলার রাজাদের সাথে সমঝোতা করতেন, কিন্তু বেশিরভাগই, বিশেষ করে পাঠানরা, বাংলার জীবনযাত্রার
সরলতা, প্রাচুর্য এবং অন্যান্য সুবিধাগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে (যা সরকারী রেকর্ডে 'রাজ্যের স্বর্গ' (Jannat-ul-Balā-جنت البلہ) নামে পরিচিত ছিল), এটিকে তাদের স্থায়ী
নিবাসে পরিণত করতেন।
'লোটাস ইটার্স-Lotus
Eaters'
তারা বাংলাকে
এমন একটি মনোমুগ্ধকর ও আলস্যপূর্ণ (আরামদায়ক) ভূমি হিসেবে পেয়েছিল যে তারা তাদের উত্সভূমি
ভুলে গিয়েছিল। বাংলার অত্যন্ত উর্বর মাটি, শিথিল বায়ু, ঝকঝকে প্রবাহ ও চিরসবুজ গাছপালা,
মনোমুগ্ধকর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত তাদের ক্লান্তিকর (দীর্ঘ যুদ্ধ-বিগ্রহ) ভ্রমণের পর
তাদেরকে নির্ভেজাল এই বিশ্রামের স্বর্গে আকৃষ্ট করেছিল। তারা তাদের বাড়ি, তাদের সন্তান,
স্ত্রী এবং দাসদের আহ্বানেও (পিছুটানে) সাড়া দেয়নি এবং মনে হয়েছিল যে তারা টেনিসনের
'লোটাস ইটার্স' (১) এর মতো গান গাইছে:
They sat
them down upon the yellow sand,
Between
the sun and moon upon the shore;
And
sweet it was to dream of Fatherland,
Of
child, and wife, and slave; but evermore
Most
weary seem'd the sea, weary the oar,
Then
someone said, "We will return no more";
And all
at once they sang, "Our island home
Is far
beyond the wave; we will no longer roam."
(তারা হলুদ বালির উপর নিজেদের বসিয়ে,
তীরে সূর্য ও চাঁদের মাঝে;
এবং পিতৃভূমির স্বপ্ন (স্মৃতিকাতরতা) মিষ্ট ছিল,
সন্তানের, স্ত্রী'র এবং ক্রীতদাসের; কিন্তু সর্বক্ষণ;
সবচেয়ে ক্লান্ত লাগছিল সমুদ্র; যুদ্ধে ক্লান্ত,
অতঃপর কেউ একজন বললো "আমরা আর ফিরবো না",
এবং একযোগে তারা গেয়ে উঠল, "আমাদের দ্বীপের বাড়ি-
ঢেউ ছাড়িয়ে অনেক দূরে: আমরা আর ফিরব না")
শাহ জাহানের
দরবারের চিকিৎসক এবং বিখ্যাত ভ্রমণকারী ফ্রান্সিস বার্নিয়ার, যিনি ১৬৬৫ সালে বাংলা
ভ্রমণ করেছিলেন, যথার্থভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, "বাংলায় প্রবেশের জন্য শত শত দরজা
খোলা, কিন্তু প্রস্থান করার জন্য একটি ও নয়।" এটি প্রায় সকল ইউরোপীয় ভ্রমণকারীর
মতামত ছিল যারা বাংলায় ভ্রমণ করেছিলেন:- (মির্জা গালিবের ফার্সী গজল থেকে)
زباندان محبت بوده ام دیگر نمی دانم
জাবান-এ মহব্বত বুদে আম দিগার ন্যাম
همی دانم که گوش از دوست پیغامی شنید اینجا
হামি দানাম কে গুশ আজ দোস্ত পেঘামি
শোনিদ ইনজা
حزین از راه گرد پیما بسے سرگشتگی دیدم
হাযিন আজ রাহ-এ গার্দ-পেমা বাসি সরগশ্তেগী
দীদাম
سر شوریده در بالین آسائش رسید اینجا
সর শুরীদা দার বালিন আসাইশ রসীদ ইনজা
অনুবাদঃ
আমি প্রেমের ভাষায় কথা বলেছি, কিন্তু
এখন আর কিছুই জানি না।
আমি শুধু জানি যে, বন্ধু থেকে এখানে
একটি বার্তা এসেছে।
ভ্রমণের পথে অসন্তুষ্ট হয়ে আমি অনেক
বিভ্রান্তি দেখেছি।
একটি উত্তেজিত (অস্থির) মস্তিষ্ক এখানে
শান্তি পেয়েছে।
পাদটীকাঃ
১. ইউরোপে
একটি কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল যে লোটাস খাওয়া মানুষরা তাদের বাড়ি এবং বন্ধুদের ভুলে
যেত এবং তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাও হারিয়ে ফেলত। তারা শুধু লোটাসের দেশে
অলসভাবে জীবন কাটাতে চাইত। তেমনিভাবে পশ্চিম ভারতের লোকেদের মধ্যে একটি ধারণা ছিল যে
যারা বাংলায় যেত তারা বাংলার জাদুবিদ্যার প্রভাবে 'ভূত' হয়ে যেত এবং তাদের মাতৃভূমিতে
ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলত।
'বাংলার জাদুবিদ্যা'
পরবর্তীতে
নতুন পরিবেশের সাথে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে তারা বাংলার মুসলিম জনসংখ্যায় মিশে যায়।
পশ্চিম ভারতের মানুষের ভেতরে বাংলার প্রতি এই অপরিবর্তনীয় আকর্ষণকে রূপকভাবে 'বাংলার
জাদুবিদ্যার' (১) প্রভাব হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। দাবি করা হয় যে, বাংলার, বিশেষ
করে পূর্ব বাংলার, বেশিরভাগ উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবার আন্তঃবিবাহের ফলে উদ্ভূত
হয়েছে এবং আমাদের এই দূরবর্তী ভূমিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।
পাদটীকাঃ
১. আইন-ই-আকবরি,
তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি এবং বিভিন্ন ইতিহাস, সাহিত্য ও লোককাহিনীর বইগুলিতে বাংলার বিশেষত
কামরূপ-কামাখ্যার (আসাম) জাদুবিদ্যা সম্পর্কে গুরুতর আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের শৈশবে
বয়স্করা আমাদের কামরূপ-কামাখ্যার ডাইনি ও অপ্সরাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে বলতেন। কিন্তু
দুর্ভাগ্যবশত কৈশোরে পৌঁছানোর পর আমরা কখনও তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করিনি।
সুফি প্রচারকগণ
মুসলিম জনসংখ্যা
বৃদ্ধির অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল মহান সুফিদের দাওয়াতী কাজ ও ধর্মান্তরিত
করার উদ্যোগ। মূলত বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের অনেক আগেই আরব নাবিক ও ব্যবসায়ীরা
ধর্মপ্রচার কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। সুফিরা পশ্চিম থেকে বিপদসঙ্কুল যাত্রা করে এবং
জীবনের সব প্রিয় ও মূল্যবান জিনিস ত্যাগ করে এখানে এসেছিলেন শুধুমাত্র বাংলার অবনমিত
হিন্দুদেরকে ইসলামের উচ্চ মানদণ্ডে উন্নীত করতে। তখন বাংলার জনসাধারণ স্বর্গপ্রদত্ত
ব্রাহ্মণ অলিগার্কির জুতোর তলায় নিষ্পেষিত হচ্ছিল; ওরা (উচ্চবর্ণ) তাদেরকে (নিম্নবর্ণকে)
দাস ও বঞ্চিত হিসেবে ব্যবহার করত এবং তাদের ন্যুনতম মানবিক অধিকার পর্যন্ত স্বীকার
করত না। একজন ইউরোপীয় লেখক বলেন, "ভারতের অন্য কোন স্থানে হিন্দু ধর্ম বাংলার
মত এত বেশী অবনমিত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল না। (ভারতের) অন্য কোন স্থানে বাংলার মত
করে জনসাধারণকে এত তাচ্ছিল্য ও অমানবিকতার সাথে আচরণ করা হয়নি। "সে মুহূর্তে
সুফিরা তাদেরকে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাপারে সম্পূর্ণ সমতার পথ দেখান। তারা (সুফিরা)
পবিত্র কোরআনের আলোকে তাদেরকে একটি সর্বাঙ্গীন জীবন ব্যবস্থার সন্ধান দিয়েছিলেন, যা
তারা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। সুতরাং হিন্দুরা তাদের নতুন বিজেতাদের অধীনে নিরাপদ
আশ্রয় পেয়ে স্বতস্ফুর্তভাবে হাজারে হাজারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। এই
শান্তিপূর্ণ ও ধর্মীয় সাধনায় অনেক সুফি শত্রুদের হাতে তাদের জীবন হারিয়েছিলেন। আল্লামা
ইকবাল তাঁর طلوع اسلام-Tulu-e-Islam (ইসলামের উত্থান) কবিতায় বলেছেনঃ-
بنا کردند خوش رسمی خاک و خون غلطیدن
বনা কার্দান্দ খুশ রস্মি খাক ও খুন
গলতিদান
رحمت کند این عاشقان پاک طینت را خدا
রহমত কানাদ
ইন আশেকান পাক তীনত রা খোদা
অনুবাদঃ
তারা ধূলা ও রক্তে গড়াগড়ি
করার একটি মহৎ রীতি প্রতিষ্ঠা করেছিল।
খোদা এই পবিত্র অন্তরের প্রেমিকদের
উপর রহমত বর্ষণ করুক।
সৌভাগ্যবশত,
তখন বাঙালি ও অ-বাঙালির প্রশ্নটি সামনে আসেনি, কারণ আগন্তুকরা সম্পূর্ণরূপে বাঙালিদের
সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিলেন। তারা আমাদের সুখ-দুঃখে অংশ নিয়েছিল এবং আমাদের সাথে
মিশে গিয়েছিল। মহান কবি ইকবালের দৃষ্টিতে: -
یابان محبت دشت غریب بھی ہے وطن بھی ہے
ইয়াবান-এ মোহাব্বত দাশত-এ গরীব ভী
হ্যায়, মতন ভী হ্যায়
يه ويرانه قفس بھی آشیانه بھی چمن بھی ھے
ইয়ে ভীরানা কাফাস ভী আশিয়ানা ভী
চমন ভী হ্যায়
অনুবাদঃ
প্রেমের মরুভূমি একটি অজানা বনভূমি, কিন্তু এটি আমার মাতৃভূমিও।
এই ভগ্নস্তূপ একটি খাঁচাও, একটি বাসাও
এবং একটি বাগানও।
পাকিস্তান
অর্জনের পর আমরা দেখতে পেয়েছি যে, যদিও ভিন্ন পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
শুরু করেছে, আশা করা যায় যে কেবলমাত্র কিছুটা সমন্বয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সময়ের
সাথে সাথে এর পূর্ণাঙ্গ রূপান্তর সম্পন্ন হবে।
গৌড়, লখনৌতি,
পান্ডুয়া এবং সোনারগাঁও
তুর্কিরা
গৌড় ওরফে লখনৌতি থেকে শাসন শুরু করে। ১৩৪০ সালের দিকে সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহ বাংলার
রাজধানী গৌড় থেকে পান্ডুয়ায় স্থানান্তরিত করেন, যা পরে সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ
শাহের নামে ফিরোজাবাদ নামে পরিচিত হয় (১৩০১-২২)। ইতিমধ্যে ১৩৩৮ থেকে ১৩৫২ সাল পর্যন্ত
স্বল্পকালের জন্য বাংলা পূর্ব ও পশ্চিমের দুটি প্রদেশে বিভক্ত হয়েছিল এবং ভিন্ন ভিন্ন
সুলতান দ্বারা শাসিত হয়েছিল। এ সময়ে পশ্চিম অঞ্চলের রাজধানী ছিল ক্রমানুযায়ী গৌড়,
ফিরোজাবাদ এবং পান্ডুয়া, (বর্তমানে মালদা জেলায় অবস্থিত), তখন পূর্ব অঞ্চলের রাজধানী
ছিল সোনারগাঁও (সুবর্ণগ্রাম) (১), যা তখন লক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনার সংযোগস্থলে
অবস্থিত ছিল।
পাদটীকাঃ
১. সোনারগাঁও
থেকে বৌদ্ধ যুগের অনেক প্রতিকৃতি ও অন্যান্য নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। তুর্কি ও পাঠান
আমলে সোনারগাঁও ঢাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে নির্দেশ করত। জাহাঙ্গীরের আমল থেকে সোনারগাঁও
ঢাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়।