বেশ অনেকদিন আগে, আমার এক বয়োজ্যেষ্ঠ
সাহাবউদ্দিন ভাইয়ের সাথে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপকালে- বাঙলাদেশের ‘মরণফাঁদ’ ফারাক্কা
বাঁধের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক লং-মার্চকে, দেশের ভারতপন্থী প্রগতিশীল রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীরা
প্রকাশ্যে কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করেছিলেন- এই কথাটি যখন তুলি, তখন সাহাবউদ্দিন ভাই এক আচানক
কথা শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাঙ্গাদেশে আবার প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী কোথায়
পেলেন? এদেশের বুদ্ধিজীবীরা তো সব ব্রাহ্মণ’। বন্ধুর কথার অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে
বুঝতে না পেরে বলি, ‘ভাই, আমি হিন্দু বুদ্ধিজীবীর কথা বলিনি, বলেছি মুছলমান বুদ্ধিজীবীর
কথা’। আমার কথার পিঠে সাহাবউদ্দিন ভাই বলেন, ‘আমিও তো হিন্দু বামুনের কথা বলছি না,
বলছি মুছলমানের ঘরে পয়দা হওয়া বামুনের কথা। আরো বলছি শুনে রাখুন, এখন বুঝবেন না, পরে
বুঝবেন- ‘বাঙলাদেশ আসলে এক হিন্দুরাষ্ট্র’।
আল্লাহ-তাআলার মর্জিতেই হোক বা প্রাকৃতিক-ঐতিহাসিক
কারণেই হোক, বাঙলাদেশের প্রায় ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠী ধর্মীয় পরিচয়ে মুছলমান। এটা তাদের সৌভাগ্য
না দুর্ভাগ্য সেটি পরে বলা যাবে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুছলমানের এই দেশে ৫০টি মন্দিরের
পাশে আছে ১ হাজার মছজিদ। এখানে লক্ষ লক্ষ হিন্দু-বৌদ্ধ যেমন নানা দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা
করেন, তেমনি কোটি কোটি মুছলমান এক আল্লাহর ইবাদত করেন, কোরআনকে পবিত্রতম গ্রন্থ মনে
করেন, হজরত মুহাম্মদকে (সঃ) আল্লাহর রসুল ও শ্রেষ্ঠ আদর্শ-মানব বলে মানেন। কল্যাণের
জন্য তারা নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন। তাদের মা-খালা-চাচী-ফুফুরাও নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন।
এমনকি সাহাবউদ্দিন ভাই যাদের ‘ব্রাহ্মণ’ বলেছেন (নিশ্চয়ই নামাজ না পড়ার জন্য বলেননি,
অন্য কারণে বলেছেন), তাঁদের মা- খালা-ফুফুরাও নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন। সেই ৯০ শতাংশ
মুছলমানের দেশ ‘হিন্দুরাষ্ট্র’? কী আজব কথা! সাহাবউদ্দিন ভাইয়ের মাথা খারাপ হ’য়ে যায়নি
তো? সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু-জনগোষ্ঠীর দেশ ভারত না হয় ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ হতে পারে। কিন্তু
তাই বলে বালাদেশকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বলা বদ্ধ উন্মাদের প্রলাপ ছাড়া আর কী?
পাঠক বিশ্বাস করুন, আমার এই মুরব্বী
বন্ধুটির কথা শুনে সেদিন তাঁকে অন্ধ ভারত-বিদ্বেষী, ঘোরতর হিন্দু-বিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট
বলে সন্দেহ করেছিলাম। আকস্মিকভাবে সেদিন তাঁর সম্পর্কে আমার মনে আরো নানারকমের সন্দেহ
তৈরী হয়েছিল। সত্যি বলছি, সেদিন মোটেও ভাবিনি- বাঙ্গাদেশকে কথিত ‘হিন্দুরাষ্ট্রে’র
চেয়েও বিপজ্জনক- ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ-কবলিত রাষ্ট্র’ আখ্যা দিয়ে একদিন আমাকেই প্রবন্ধ লিখতে
হ’বে। সুতরাং পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, পাঠক সহজেই আন্দাজ করে নিতে পারেন।
রাষ্ট্র নিয়ে কথা ব’লতে হ’লে প্রথমেই
বলে নিতে হয় একটি দেশ স্বাধীন হলেই রাষ্ট্র হ’য়ে যায় না। রাষ্ট্র গঠন ক’রতে হয়। আবার
রাষ্ট্র যেনতেন প্রকারে গঠন ক’রলেই হয় না। রাষ্ট্র যথার্থভাবে গঠন ক’রতে হয়। যথার্থ
রাষ্ট্র ব’লতে বোঝায়- গণতান্ত্রিক জাতীয় রাষ্ট্র। কিন্তু জাতীয় রাষ্ট্রের
সংজ্ঞা নিয়ে অনেকেরই ধারণা অপরিষ্কার ও বিভ্রান্তিকর। সত্যিকারের জাতীয় রাষ্ট্র হ’ল-
‘রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদে’র ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ হ’ল ধর্ম, বর্ণ
ও নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তার পরিবর্তে, রাষ্ট্রের নাগরিকতার পরিচয়ে জাতীয়তাবাদ। এর অর্থ
হ’ল, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে এবং ধর্ম ও বর্ণের পরিচয়ে যতগুলো জাতি
ও জাতিসত্তা থাকবে, সেই-সকল জাতি ও জাতিসত্তার অভিন্ন (কমন) নাগরিকত্ব এবং সম-অধিকার
ও সম-মর্যাদার ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র। বাঙলাদেশ সে রকম কোন রাষ্ট্র নয়। এটা একটা একক-সংকীর্ণ
জাতীয়তাবাদ (বাঙালি জাতীয়তাবাদ) এর ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র। অবশ্য বাঙালি জাতীয়তাবাদসহ
এ রাষ্ট্রের নানান ধরন নিয়ে ইতিমধ্যে আমরা আরও নানা- জটিলতার মধ্যে পড়ে গেছি।
লেখার শুরুতেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ‘হিন্দুরাষ্ট্রে’র
যে কথাটা এসেছে, সেটি- ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ (বা ‘মুছলিমরাষ্ট্র’) ভালো কি মন্দ সে অর্থে
নয়। প্রাচ্যের দেশগুলোতে ধর্মের একটা বড় প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে বলে উপমহাদেশে হিন্দুরাষ্ট্র-মুছলিমরাষ্ট্র
প্রসঙ্গটা আসে। যেমন ধর্মনিরপেক্ষ-রাষ্ট্রের আড়ালে হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ ভারতকে
‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বলা হয়। অন্যদিকে মুছলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েই
‘মুছলিম-রাষ্ট্র’। অর্থাৎ দুটোই প্রায় এক ধরনের ‘ধর্মরাষ্ট্র’।
তবে বিশেষভাবে নজর করার বিষয় হ’ল,
বর্তমান আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু বাঙলাদেশ-ই কেবল এক ব্যতিক্রমী রাষ্ট্র। ব্যতিক্রমটি,
বাঙ্গাদেশ কোন ধর্মরাষ্ট্র কিনা, এ কারণে নয়। আবার এটা ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বা ‘মুছলিমরাষ্ট্র’
কিনা একারণেও নয়। বরং সাংবিধানিক ঘোষণায় ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’ চেতনার আলোকে এবং কথিত
‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রের আড়ালে এটা অন্য এক ‘কিছিমে’র রাষ্ট্র। এই অন্য কিছিমের রাষ্ট্রটি
সাহাবউদ্দিন ভাইয়ের ভাষায় ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ কিনা, অথবা আমাদের ধারণায় ব্রাহ্মণ্যবাদ-কবলিত
রাষ্ট্র কিনা এই প্রশ্নটি সামনে নিয়েই বর্তমান লেখার আয়োজন।
আবার আমাদের মূল্যায়ন যদি যথার্থ হয়
তাহলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুছলমানের এই দেশটি কীভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদ-কবলিত রাষ্ট্র হতে
পারে এমনকি এ রাষ্ট্রের ক্ষমতায় শুধু ভারতপন্থী আওয়ামী লীগ নয়, পনেরো বছর ‘ভারতবিরোধী’
বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকলেও, বিয়াল্লিশ বছর এটা কী করে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী চেতনা-কবলিত
রাষ্ট্র রয়ে গেলো, সেই বিষয়ে তত্ত্ব- তালাশ করাই আজ আমাদের জরুরী কাজ। বলে রাখা দরকার,
এই তত্ত্ব- তালাশের কাজটি করতে গিয়ে ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যবাদ শব্দগুলো
বহুবার আসবে। বাঙ্গাদেশে কোন মুছলমান লেখকের লেখায় ব্রাহ্মণ, হিন্দু, ব্রাহ্মণ্যধর্ম,
ব্রাহ্মণ্যবাদ এই কথাগুলো উচ্চারিত হলেই তাকে ‘হিন্দু-বিদ্বেষী’, ‘ভারত- বিদ্বেষী’
ও ‘সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট’ বলে গালি দেওয়া হয়। বর্তমান রচনায় এই শব্দগুলো ওইরকম কোন উদ্দেশ্য
নিয়ে ব্যবহার করা হয়নি। বরং গোটা উপমহাদেশের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস-বিচার ক’রতে গিয়ে
প্রাসঙ্গিকভাবেই ওই শব্দগুলো এসেছে।
ব্রাহ্মণ্যবাদ হ’ল জাত-পাতের প্রতীক,
বর্ণ-বিদ্বেষ ও বর্ণ-নিপীড়নের প্রতীক, পরধর্ম-বিদ্বেষ ও পরজাতি-বিদ্বেষের প্রতীক। এ
কারণে উপমহাদেশের হিন্দু- মুছলিম-বৌদ্ধ-খৃষ্টান নির্বিশেষে কেউই ব্রাহ্মণ্যবাদকে সমর্থন
করেন না, বরং তার বিরোধিতা করেন। এমনকি আজকের আধুনিক ভারতে অনেক ব্রাহ্মণরাও, ব্রাহ্মণ্যবাদের
সমালোচক। তাই ব্রাহ্মণ্যবাদের সমালোচনা করা বা তার বিরোধিতা করা কোন সাম্প্রদায়িকতা-চর্চা
নয়।
অথচ বাঙ্গাদেশ ও ভারতের একশ্রেণীর
প্রগতিবাদী পণ্ডিত-বুদ্ধিজীবীরা-ব্রাহ্মণ্যবাদের সমালোচনা ও বিরোধিতা করা বা তার বিরুদ্ধে
লেখালেখি করাকে মনে করেন ‘হিন্দু-বিদ্বেষ’। হিন্দু-বিদ্বেষ নিশ্চয়ই সাম্প্রদায়িকতার
দোষে দুষ্ট। এর বিপরীতে মুছলিম-বিদ্বেষও সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট। এই ধরনের সাম্প্রদায়িক
বিদ্বেষ সমাজের বিষ। কিন্তু তাই বলে ব্রাহ্মণ্যবাদের সমালোচনা বা বিরোধিতা কোনভাবেই
হিন্দু-বিদ্বেষ হতে পারে না। একই বিচারে মুছলিম সম্প্রদায়ের ভেতরে যদি ব্রাহ্মণ্যবাদের
অনুরূপ চরিত্রের আলামত থাকে, তবে তার সমালোচনা এবং বিরোধিতাও মুছলিম-বিদ্বেষ নয়। ব্রাহ্মণ্যবাদ-
বিরোধিতাকে বুদ্ধিজীবীরা কী কারণে এবং কী উদ্দেশ্যে হিন্দু-বিদ্বেষ মনে করেন, তার রহস্য
তাঁরাই ভালো জানেন।
দোছরা কথা হ’ল- রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নীতি
অনুযায়ী যে কোন রাষ্ট্রের জন্য, অন্য কোন রাষ্ট্রকে তার সম্ভাব্য শত্রু গণ্য করা জায়েজ।
সে হিসেবে ভারত-রাষ্ট্র যেমন বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের সম্ভাব্য শত্রু, তেমনি বাঙলাদেশ-রাষ্ট্রও
ভারত-রাষ্ট্রের সম্ভাব্য শত্রু। তবে ভারতের জনগণ কখনই বাঙ্গাদেশের জনগণের শত্রু নয়
এবং বাঙ্গাদেশের জনগণও ভারতের জনগণের শত্রু নয়। আবার দুই দেশেরই অভ্যন্তরে হিন্দু ও
মুছলমান কখনই একে অপরের শত্রু নয়।
তাছাড়া রাষ্ট্রীয় ও জাতিগতভাবে বাংলাদেশের
জনগণের নতুন ক’রে কোন শত্রু তৈরী বা আবিষ্কারের প্রয়োজন পড়ে না। বৃটিশ-ভারতে দু’শ’
বছর বাঙলার, বিশেষত এপার বাঙলার (বাঙলাদেশের) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুছলমান এবং নিম্নবর্ণীয়
হিন্দু-বৌদ্ধ জন। কওমের ধর্ম, ভাষা, জাতি, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি যে শত্রুতা
করা হ’য়েছে এবং স্বাধীন বাঙ্গাদেশের বিয়াল্লিশ বছরেও যার হেরফের ঘটেনি সেই ইতিহাস,
কারও অপবাদের তোয়াক্কা না করে, অবশ্যই আমাদের তুলে ধ’রতে হ’বে।
ইতিহাসের সন্ধানে
বন্ধু সাহাবউদ্দিন যে-অর্থে বাঙ্গাদেশের
বুদ্ধিজীবীদের ‘ব্রাহ্মণ’, আর বাঙলাদেশকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বলেছেন তা বোঝা আসলেই একটু
মুশকিল। ব্যাপারটা অনেক জটিলও বটে। বাঙলা, বাঙলাদেশ ও বাঙালি জাতির ইতিহাস ভালোভাবে
না জানলে তা বোঝা যাবে না। তাছাড়া কোন্ গূঢ় অর্থে এই ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বলা, তার একটা
খোলাছা ব্যাখ্যা না দিলেও বিষয়টি পরিষ্কার হবে না।
বাঙলাদেশের আপন ইতিহাস বিস্তারিত জানতে
হলে ইতিহাসের সন্ধান ক’রতে হ’বে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ইতিহাস পড়ে আমরা বিদ্বান
হ’য়েছি, বুদ্ধিজীবী-পণ্ডিত হ’য়েছি, সেই ইতিহাসে আমাদের চলবে না। কারণ, এ ইতিহাস মিথ্যা,
বিকৃত, অ-সত্য। প্রকৃত ইতিহাস মাটির নিচ থেকে বের ক’রে এনে আমাদের পাঠ করতে হ’বে। আমাদের
ওপর মিথ্যা ও বিকৃত ইতিহাস চাপিয়ে দিয়ে জাতির ভাষার ইতিহাস, লিপির ইতিহাস, ধর্মের ইতিহাস,
রাজনীতি ও সংস্কৃতির-ইতিহাস আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হ’য়েছে। সেই ইতিহাস খুঁজে বের করে
আমাদের পাঠ করতে হ’বে।
সেই ভুলিয়ে দেওয়া ইতিহাস আমরা কোথায়
পাবো? এ প্রসঙ্গে পাঠকের দৃষ্টি-আকর্ষণ করে বলছি বালাদেশের শিক্ষিত লোকদের, বিশেষকরে
নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের- বাঙলা, বাঙলাভাষা-লিপি ও বাঙালি জাতির সত্য
ইতিহাস জানার জন্য আপাতত হাতেগোণা যে কয়খানা বই সংগ্রহ করে মনোযোগ সহকারে পাঠ করা খুবই
জরুরী, সেগুলো হ'ল- ভারতীয় লেখক বিবশ্বান বসুর ‘মিথ্যাময় ইতিবৃত্ত’, শ্রী বি. আর্যর
‘ভারতীয় বাঙলার প্রাচীন যুগের ইতিহাস লেখার নেপথ্য কথা’, রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘বঙ্গীয়
কূলশাস্ত্র’, দীনেশচন্দ্র সেনের দুই খণ্ডে লেখা ‘বৃহৎ বঙ্গ’, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের
‘বাঙ্গালীর ইতিহাস ও সাহিত্যে প্রগতি’, ইরফান হাবিবের ‘মোগল আমলের কৃষি-ব্যবস্থা’,
গোলাম আহমাদ মোর্তজার ‘চেপেরাখা ইতিহাস’, ‘ইতিহাসের ইতিহাস’ ও ‘বজ্রকলম’ এবং গৌতম ভদ্রের
‘ইমান ও নিশান’। বাঙলাদেশি লেখক আবুল মনসুর আহমদের ‘বাঙলাদেশের কালচার’, ড. এম. এ.
রহিমের ‘বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস’, মমতাজুর রহমান তরফদারের ‘হোসেনশাহী আমলে
বাঙলা’, ফরহাদ মজহারের ‘রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ’। সেই সাথে আরো রয়েছে বাঙলাদেশের
ভাষা, লিপি, সাহিত্য ও ইতিহাস পাঠকদের গতানুগতিক চিন্তার গিটগুলোকে বড় রকমের ঝাঁকুনি
দে’য়ার মত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও নজরুল-প্রফেসর ডক্টর
এস. এম. লুৎফর রহমানের লেখা ‘বাঙালীর লিপি, ভাষা, বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস’
গ্রন্থটি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী এ-লেখকের নানা বিষয়ে বিশাল গবেষণাকর্মের
অন্যতম- তিন খণ্ডে এক হাজার পৃষ্ঠার এই বিরল গবেষণা-গ্রন্থটি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে- এমনভাবে
লোকচক্ষুর আড়ালে অবহেলায়-অবজ্ঞায় পড়ে আছে যে, নতুন প্রজন্মের লেখক-গবেষক-পাঠক-প্রকাশকরা
হয় তার খবর-ই রাখেন না অথবা খবর রাখলেও আগ্রহবোধ করেন না।
কোন জাতির ইতিহাস অধ্যয়নের সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হ’ল, সেই জাতির ভাষা, লিপি ও সাহিত্যের ইতিহাস। বাঙলাদেশ ও বাঙালি
জাতির ইতিহাস সন্ধানের এক বিশাল ক্ষেত্র হচ্ছে- অতীতে গ্রাম-বাঙলার অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকদের
লেখা পুথি-সাহিত্য। কয়েকশ’ বছর আগের কবি- সাহিত্যিকদের লেখা হাজার হাজার পুথি-কেতাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে বহু বছর ধরে। অযত্নের
কারণে বহু পুথি ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। এসব পুথি-কেতাবের ওপর কোন গবেষণাকর্ম অথবা
সাধারণ পাঠকদের সে সব অধ্যয়নের সুযোগ প্রদানের কোন উদ্যোগ নেই। হিন্দু-কবিদের পুথি
নিয়ে কলকাতায় অনেক গবেষণা হয়েছে, কিন্তু মুছলিম কবিদের পুথি-কেতাব নিয়ে কলকাতায় তো
নয়-ই, এমনকি ঢাকায়-ও তেমন কোন গবেষণা হয়নি। জানা যায়, বিশ শতকের গোড়ার দিকে ড.
মুহম্মদ এনামুল হক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গিয়েছিলেন
পুথি-সাহিত্যের ওপর ডক্টরেট করার জন্য। কিন্তু তাঁকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি।
তার বদলে তাঁকে ছুফী-সাহিত্যের ওপর ডক্টরেট ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করা হয়। পুথি-সাহিত্যের
ওপর এই অবহেলা বাঙ্গাদেশ ও তার জনগোষ্ঠীর ইতিহাস সন্ধানের কাজে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি
করে রেখেছে দীর্ঘদিন যাবত।
জানা যায়, বাঙলাদেশের বাঙালাভাষা-লিপি-সাহিত্য
(বিশেষ করে মহামূল্যবান পুথি-সাহিত্য) এবং রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতির ইতিহাসের বিশাল
ভাণ্ডার সংরক্ষিত আছে গ্রেটব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগালসহ বিশ্বের নানা দেশের
বড় বড় মিউজিয়াম ও লাইব্রেরীগুলোতে। সে সব মহামূল্যবান সম্পদ উদ্ধার করে বালাদেশে এনে
তার ওপর ব্যাপক গবেষণার উদ্যোগ, স্বাধীন বাঙলাদেশের কোন সরকারের আমলেই নেওয়া হয়নি।
এমনকি এমন তথ্যও আছে- পর্তুগালের লিসবনে সংরক্ষিত বাঙলাদেশের প্রাচীন পুথি-সাহিত্যের
বিশাল ভাণ্ডারটি গ্রহণ করার জন্য লিসবন-পাঠাগার কর্তৃপক্ষ, ঢাকার বাঙলা একাডেমীকে অনুরোধ
জানালে, বাঙলা একাডেমীর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাত কারণে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। এটা
জাতির জন্য বড় লজ্জাজনক।
বাঙলাদেশ-রাষ্ট্র সম্পর্কে সাহাবউদ্দিন
ভাইয়ের ঘোরতর আপত্তিকর মন্তব্যের তাৎপর্য বোঝার জন্য এখানে আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রসঙ্গ
তুলে ধরা প্রয়োজন। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম-প্রগতিশীল ছাত্রদের একটি অধ্যয়নচক্রের
জন্য পুস্তিকা আকারে তৈরী পাঠ্যসূচী আমার হাতে আসে। তাতে বামপন্থীদের গতানুগতিক পাঠ্যসূচীর
সাথে ভারত ও বাঙলার ইতিহাস অধ্যয়নের পাঠক্রম যুক্ত হয়েছে। সেখানে ভারত
ও বাঙ্গার ইতিহাসের যে সব বিষয় স্থান পেয়েছে তা হ’ল- আর্যদের ইতিহাস, বৌদ্ধদের
ইতিহাস ও ব্রিটিশদের ইতিহাস। আশ্চর্যজনকভাবে ভারতবর্ষ ও বাঙলার সাড়ে সাতশ’ বছরের মুছলিম
শাসনের ইতিহাস সেখানে স্থান পায়নি। অনুমান করা যায়, প্রগতিশীল ছাত্রদের জন্য
সে ইতিহাস নিষিদ্ধ। এর কারণ একটাই হ’তে পারে সেটা হ’ল, সেই ইতিহাস মুছলমানের ইতিহাস,
ওর মধ্যে ইছলামেরও গন্ধ আছে। কাজেই ওই ইতিহাস পড়া যাবে না। পড়লে ‘মৌলবাদী’ হয়ে যেতে
হবে। দেশের মেধাবী তরুণ প্রজন্মের মন-মানসিকাতার এই যে বেহাল অবস্থা, তা গোটা জাতির
জন্য শুধু লজ্জাকর নয়, চরম দুর্ভাগ্যজনকও বটে। আর এর মধ্য দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রের চেহারাটা
কী তা-ও ফুটে ওঠে।
আমরা বাঙলাদেশের মানুষ যে বিয়াল্লিশ
বছরেও জাতির সঠিক আত্মপরিচয় (ন্যাশনাল আইডেনটিটি) ঠিক করতে পারিনি তার কারণ, আমরা জাতির
প্রকৃত ইতিহাস তত্ত্ব-তালাশে মনোযোগী হইনি। জাতির ইতিহাস যে ভাষার ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতির
ইতিহাস তা খেয়াল করিনি। আবার ভাষা- সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস যে অন্য সবকিছুর সাথে
ধর্মেরও ইতিহাস, সেটাও কখনও খেয়াল করিনি। আমরা প্রতিবেশী ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর
ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর ব্রাহ্মণ্য-ধর্মীয় চেতনার বিপুল প্রভাব দেখি, দেখে মুগ্ধও
হই কিন্তু নিজেদের ধর্মীয় চেতনা-আশ্রয়ী ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে দেখি অবজ্ঞার চোখে।
অন্যের ধর্মের ইতিহাস-সংস্কৃতিকে বলি প্রগতিশীল, আর নিজের ধর্মের ইতিহাস-সংস্কৃতিকে
বলি ‘পশ্চাৎপদ’, ‘মধ্যযুগীয়’। এমনকি অনেক ধর্মপ্রাণ লোকেরাও তথাকথিত প্রগতিশীলদের দ্বারা
বিভ্রান্ত হন। এমনই হীনম্মন্য জাতিতে পরিণত হয়েছি আমরা।
আমাদের ভাষা-লিপি, সাহিত্য-সংস্কৃতির
ইতিহাস, আমাদের জাতির ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে আমাদের ওপর অন্যের ভাষা-লিপি-সাহিত্য-সংস্কৃতির
ইতিহাস চাপিয়ে দিয়ে আমাদের আত্মপরিচয় মিছমার করে দে'য়া হয়েছে। সেই চাপিয়ে দে’য়া ইতিহাস
আমাদের মগজধোলাই ক’রে দিয়েছে। সুতরাং নিজের সত্য-ইতিহাস উদ্ধার করা ছাড়া আমাদের মাথা
উঁচু করে দাঁড়াবার উপায় নাই।
সূত্র-আত্মবিস্মৃত বাঙালী
রইস উদ্দিন আরিফ